পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৮

চারটি অনুগল্প

চারটি অনুগল্প

আরও একটি ভাষা আন্দোলন 

খুব উজ্জ্বল সবুজ সুবজ পাতার একটি গাছ, বিশাল গাছ। পাতাগুলো বড় বড়। লাল রঙের গোল গোল ফল সেই সবুজ পাতারগুলোর মাঝে মাঝে ফু
টে আছে। পেছনে একটা নীল দিগন্ত ঝকমক করছে। গাছের তলে দাঁড়িয়ে একজন লোক বক্তৃতা দিচ্ছে। একটু দুরে গোল গোল দল হয়ে অনেক লোক সে কথা শুনছে। আমি একা দাঁড়িয়ে এক পাশে একটা গোলাপ গাছে হেলান দিয়ে আছি। নীল রঙের গোলাপ ফুটেছে। ভালো করে তাকালাম বক্তার দিকে, মাথায় জিন্না টুপী-আরে এই তো সেই খাজা নাজিমউদ্দীন যিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে হয়েছিলেন পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এ কি ভাষা বলছে, শুনেছি শুনেছি মনে হয়, কিন্তু বুঝতে পারছিনা। বাকী সকল লোকের হাবভাব দেখে মনে হচেছ তারা বুঝছেন। উর্দু নয়, উর্দু হলে কিছু কিছু বুঝতাম। ব্যাটার তো জন্ম ঢাকায়, ব্যাটা বেঁচে থাকতে ও বাংলার বিরুদ্ধে ছিলো আর এখন মরেও আরেক কি ভাষা বলছে...মরে মানে, তার মানে আমিও কি মরে গেছি..! কি আশ্চর্য! কিন্তু কখন মরলাম। ...
"এই যে ভাই, এটা কোথায়?" -শুদ্ধ বাংলায় জিজ্ঞাস করলাম । না উত্তর দিলো না, বুঝলো না মনে হয়। গোলাপ ফুলটা এখন টকটকে লাল হয়ে গেছে। বাহ! দারুন তো।
গোলাপ থেকে সরে চারদিকে চোখ মেল্লাম, কোন পরিচিত কেউ , কোন বাংগালি আছে কিনা...
কে জানো ডাকলো- এই যে আপনি "বাংলা" বলছেন , এই আপনিই তো.....
সে একা না চার পাঁচজন। চেনা চেনা লাগছে। আরে তাঁরাই তো, সে ভাষা আন্দোলনের শহীদগণ। সাদাকালো চেহারার যে ছবি গুলো দেখেছিলাম এককালে সেই রকমই।...
" আরে আপনারা, আপনারা এ ভাষা বুঝতে পারছেন ?"
উত্তর এলো, হুম শিখে নিয়েছি....
"কিন্তু বাংলায় কেনো বলেন না কথা?, চলুন ঐ খাজারে বলি যা বলছে তা বাংলায় বলুক....
অনেকগুলো কণ্ঠ যেন একসাথে বলে উঠল-হ্যাঁহ্যাঁ, বাংলায় কথা বলব, আমরা আমাদরে প্রিয় মধুর বাংলায় কথা বলব..চলুন চলুন ......
আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কণ্ঠে বাংলা বোল নিয়ে গাছটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি...হঠাৎ একটা বজ্রপাতের মত শব্দ হলো....
ঘুম ভেঙে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি বাইরে অন্ধকারের মাঝে বিদ্যুৎ চমকালো।


টাইম লুপ

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ছাতাটা বন্ধ করে এক দৌড়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। চারদিকে চোখ বুলিয়ে কেবল একজন তরুণী দেখা গেলো বসে বসে মোবাইল টিপছেন। আমিও একটা সিটে বসে পড়লাম। রাত দশটরা এই ট্রেনে এত বড় এক কম্পার্টমেন্টে কেবল এক জোড়া মানব মানবী। যেন সৃষ্টির শুরুর 
মত। বাহিরে অস্পষ্ট অন্ধকার। মোবাইল বের করলাম। দশটা পাঁচে আমার বান্ধবী ইউরিয়ানার লাইভ আছে ফেসবুকে। লাইভে গান গায় সে। প্রচুর ফ্যান তার। এইতো লাইভ অন হয়েছে। কানে হেড ফোন লাগালাম। লাইভে ক্লিক করলাম। ঠিক সেই সময় ট্রেনটাও থামলো পরের স্টোপেজে। তরুণীটি উঠলে দাঁড়ালেন। অসম্ভব সুন্দরী। চোখাচুখি হলো। তারপর পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন তরুণী। টকটকে মেরেুন একটা গাউন গায়ে। ঘাড় ঘুরালাম। মেরুন রঙের কাপড়টা ট্রেন থেমে বাইরে চলে গেলো। দরজা বন্ধ হলো। মোবাইলে চোখ ফেরালাম, ঠিক দশটা ছয় বাজে। ট্রেন সচল হলো। এই স্টেশনটির পরেই একটা টানেল। টানেলে ঢুকতে যাচ্ছে ট্রেন। ইউরিয়ানার চেহারা ভেসে উঠলো এবং কণ্ঠ কানে এলো -“ বন্ধুরা ঠিক সময়মতোই চলে এলাম, কেমন আছেন সবাই ...”
টানেলে ঢুকে গেছে ট্রেন, হঠাৎ খেয়াল হলো মোবাইলের আলো ছাড়া আর কোন আলো জ্বলছেনা। ট্রেনের ভেতরের আলো, টানেলের আলো সব নিভে গেছে যেন মুহূর্তে...
একটু পরেই আবার আলো জ্বলে উঠলো। ট্রেন থামার শব্দ, ঘার ঘুরালাম, একটা মেরুন কাপড় দরজার বাইরে সরে গেলো, দরজা বন্ধ হলো, ট্রেন চলতে লাগলো। মোবাইলে চোখ ফেরালাম, ঠিক দশটা ছয় বাজে। ইউরিয়ানার চেহারা ভেসে উঠলো এবং কণ্ঠ কানে এলো -“ বন্ধুরা ঠিক সময়মতোই চলে এলাম, কেমন আছেন সবাই ...”
টানেলে ঢুকে যাচ্ছে আবার ট্রেন, হঠাৎ মোবাইলের আলো ছাড়া আর সেব আলো নিভে গেলো... একটু পরেই আবার আলো জ্বলে উঠলো। ট্রেন থামার শব্দ, ঘার ঘুরালাম, একটা মেরুন কাপড় দরজার বাইরে সরে গেলো, দরজা বন্ধ হলো...
একি! আমি যে টানেলের ভেতর থেকে ঢুকে পড়েছি এক ‘টাইম লুপে’!




পলিথিন

ইত্তেফাক মোড় থেকে মতিঝিলের দিকে মোড় নিতে নিতে বন্ধু মামুনকে জিজ্ঞেস করলাম, এইখানেইতো ম্যাডোনা নামের সেই রেস্তোরাটা ছিলো, ভালো শিক কাবার বানাতো, সব ভেঙেচুড়ে একুশ তলা বিল্ডিং উঠাচ্ছে। মামুন বললো, হুম দুই বছর পর দেশে এসেছিস, কত কিছুই দেখবি 
বদলে গেছে। আরেকটু সামনে হেঁটে মধুমিতা সিনেমা হলের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। হঠাৎ আইল্যান্ডে বসা পথকলি ছেলেমেয়েগুলোর দিকে চোখ পড়ল। বন্ধুও আমার তাকানো বুঝতে পেরেছে, কেমন একটা হাতাশার হাসিতে ঠোঁট চেপে ধরায় তার টোল ফুলে উঠেছে। বললাম, হাসছিস কেনো? পোলাপানগুলো পলিথিন মুখে শ্বাস ছাড়ছে, শ্বাস নিচ্ছে, দাঁড়া দাঁড়া ...এই কি সেই ‘পলিথিন টানা” মানা ড্যান্ডির নেশা। 
বন্ধু হাসি চেপে বললো, হুম ঠিক তাই, বাদ দে, ওদিকে তাকিয়ে লাভ নেই, এসব খুব কমোন। 
কমোন মানে, একটা জেনারেশন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমি পড়েছি, ওরা পলিথিনে জুতোর আঠা ঢুকিয়ে ফুঁ দেয়, তাতে ভেতরে বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হয় তারপর সেই গ্যাস টেনে ফুসফুসে নেয়...ভয়ংকর বিষয়, ভয়াবহ সব রোগ হতে পারে। নিশ্চয় তোর মতই সবাই ইগনোর করে বলে এর ক্ষতিকর দিক নিয়েও কোন গবেষণা হয়নি। অথচ এখন এই পলিথিন টানছে আরেকটু বড় হলেই আরও দামী দামী জিনিস লাগবে। টাকা লাগবে। ছিনতাই, ডাকাতি...ভয়াবহ এক চেইন অবক্ষয় -শারীরিক এবং সামাজিক।
আমি এটুকু বলতে বলতেই একটা পলিথিন টানা ছেলেকে কাছে ডাকলাম, বয়স ১২ কি ১৩। বললাম, এই ছেলে পলিথিন টানছো ক্যানো?
-পলিথিন খামু না তো কি খামু ? ইয়াবা-গাঞ্জার দাম তো বাইড়া গ্যাছে, দিবেন নি দুইটা টাহা, আঢা কিনমু..



বাল্যবিবাহ

-তড়িত দা, তোমার মত এত বড় গোয়েন্দা এই কাজ..দূর এ হয় নাকি?

:আরে পাগলা, বিবেক, মানবতা, আইন বলে কিছু অাছে তো, সেই কারণে এই কাজ করতেই হবে। তারোপর কালিডাঙ্গা থানার ওসি আমার অতি নিকটজন। তোর মনে নেই উনি যখন ঢাকাতে ছিলো..
-যাক, তুমিই ভালো বোঝ, তা কিভাবে প্রমাণ করবে মেয়েটা যে প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি?
:আমি না, তুই প্রমাণ করবি। আজই চলে যা কলমাডাঙায়।

...কলমাডাঙার চেয়ারম্যান হাজী হুরমত আলীর কন্যার বিবাহ বলে কথা। শোনা যায় হুরমুত আলী যৌবনকালে ডাকাত ছিলো। কোন প্রমাণ নেই-গুজবও হতে পারে। সত্য হলো আজ তিনি বিশিষ্ট একজন। সকাল থেকেই আশেপাশের সবক'টা গ্রামের লোকের মাঝে হুল্লোর। বর আসবে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে। কলেজের মাঠে নামবে। মাঠের চারদিকে সকাল থেকেই লোকে লোকারণ্য। বেলা মধ্যবলোয় পড়তেই হুরমত আলীর বাড়িতে সব বড় বড় ব্যক্তিদের পদচারণা শুরু হয়ে গেলো। আশেপাশের গন্যমান্য, উচ্চপদস্থ, কেউ বাদ যায় নি। কেবল একজন নেই -তিনি থানার ওসি, গন্যমান্যদের সিকিউরিটির ব্যবস্থা করে তারপর আবার থানায় চলে গেছেন...
ওসি সাহেবের সাথে থানায় আছেন গোয়েন্দা তড়িত। ডিএনএ রিপোর্ট, কোর্টের ওর্ডার সব সুন্দর করে ফাইলে ঢুকালেন ওসি সাহেব। 
তড়িত একটু চিন্তিত - ওসি সাহেবে ওরা এখনও আসছে না কেনো?
-চলে আসবে। আমি বিশ্বস্ত লোক পাঠিয়েছি। বুঝলনে ভাই, এত এত গন্য মান্য সব লোক কিন্তু জেনেও কিছু বলতে পারছে না। স্কুল সার্টিফিকেট, বার্থ সার্টিফিকেট সব একদম ১৮ বছর দেখিয়ে আপটুডেট করে রেখেছে। অথচ সবাই জানে কিন্তু মাত্র ১৪ বছর বয়স মেয়েটার। সে পড়তে চায়। তা আপনিই পারলেন। আপাতত এই ডিএনে রিপোর্ট আর কোর্টের অর্ডারে বিয়েটাতো থামানো যাবে...বাকীটা কোর্ট দেখবে..ঐতো ওরা চলে এসেছে। 
তড়িত দেখলো একদম মেয়ের সাজে তার শিষ্য মিমিখ আর সাথে কিউট একটা মেয়ে, অপূর্ব সুন্দর দেখতে। বুঝলো এই তাহলে চেয়ারম্যান কন্যা। 
মিমিখ বলে উঠলো- তড়িত দা গত দশ দিন ধরে এই মেয়ে সেজে থাকা, গত একটা ঘন্টা বিউটি পার্লারে মুখ ঢেকে বসে থাকা..উফ্ আর পারছিনা, মুক্তি দেও।
:চল চল, আগে বিয়েটা আটকাই।...


9/9/2018



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন