পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০১২

চাকা

চাকা
মামুন ম. আজিজ

কখনও শব্দটা ‘ভো, ভো’ আবার একটু পড়েই ‘কু ঝিক ঝিক, ঝিক ঝিক...; কিংবা ‘প্যা, পু, পু... পি.’ । একটার পর আরেকটা, অবিরত। 

প্রতিটা শব্দের সাথে গোল গোল চাকার ঘুর্ণন। চোখের মণির যাতনা পীড়িত ছিদ্রটিও গোলাকার। গোলাকার দৃষ্টিতে গোলাকার চাকাগুলো খাপে যেন খাপ খাওয়া তলোয়ার।
অথচ ছেলেটার তলোয়ার চেনার বয়স হয়নি। টিভিতে দেখার সুযোগ হতে পারত, তার মার ঘরে একটা ছোট রঙিন টেলিভিশন যদিও আছে, বয়সটা অমন হয়নি যে টিভির পর্দায় তলোয়ার চিনে নেবে। আর ঘরে ঢোকার সুযোগতো হয় সেই গভীর রাতে, তখন আর চোখের চেয়ে থাকার ক্ষমতা সীমিত থাকেনা। ঘুমের ঘোরে সারাবেলার শব্দ আর গোল গোল চাকা বৃত্তাকারে আঁকড়ে ধরে শান্তির ঘুমরাজ্যের তেপান্তরে।

তলোয়ার না চিনেই ভাল হয়েছে, চিনলে পায়ের শিকলটা ভেঙে ফেলার একটা যাচিত মানসিকতা-যন্ত্রনাকে চেনাত আরও এক রূপে। শিকলের যে অংশ পা-টাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে , সেটাও গোল। গাড়ী আর ট্রেনের চাকার মতই গোল। বহুবার-বহুদিন সেই চাকার মত গোল দৃশ্যে তাকতে তাকাতে নিজের পা-দুটোকেই আজ অচেনা আত্মীয় মনে হয় শিশু মনে। রোজ রাতে কিংবা কখনও সন্ধ্যার একটু পরেই মা এসে গোল বেড়িটা খুলে দিলেই একটা গোলাকার দাগ চোখে পড়ে- পুরো পা ঘিরে থাকে, গভীর তো বটেই কখনও সুগভীর।

বারান্দার বেড়াটা বদলেছে দু’দুবার, চকিটা ঘুনে পোকা গোল গোল গর্ত করে উদরে পুড়েছিল। ভেঙে যাবার ফলে সেটাও বদলানো হয়েছে। লিটার লিটার পেশাব আর গু সঞ্চয় করতে করতে মাদুরটাও মরেছে, ফলে বদলানো হয়েছে কয়েকবার। বারান্দায় চকি হতে বিঘাত খানিক উঁচু ভাঙা কঞ্চির খানিকটা বেড়া। চকি-বিছানা ছেড়ে বারান্দার বেড়াটা পেড়িয়ে উঠোনের মত শক্ত মাটির প্রান্তর মাড়িয়ে এগোলেই লম্বা ডোবা, সে ডোবার জল কত রূপ নিল দিনের পর দিন। তবে যার মূল রূপই কালো যতই ক্রিম পাউডার আর কাপড় কাচা রঙ, জল-বৃষ্টি পড়–ক কালোতেই সে ফিরে আসে; নতুন নতুন কচুরিপানা জন্মায়, পুরাতন কচুরিপানা গরু-গাভীর পেটে যায়, সেই গাভী গুলোর পানি মেশানো দুধ খেয়ে খেয়ে শিশুটি নিজেও দৈর্ঘ্যে প্রস্থে অনেকটা বেড়েছে, বয়স হয়েছে প্রায় চার। অথচ সেকি হিসেব জানে? মোটেও না। ঐ যে বেড়েছে গায়ে গতরেই তো কেবল। মস্তিষ্কের স্মৃতিতে কিছু ই পরিবর্তন হয়নি, চিরকাল দেখে আসা চকি , মাদুর, বেড়া, উঠোন , ডোবা, তারপর সমান্তরাল রেলপথ আরও কিছুদূর সামনে বড় রাস্তা আর গোল গোল চাকা। তেমনি পরিবর্তন হয়নি পায়ের বেড়িটাও , শিকলটা দৈর্ঘ্যে বেড়েছে কিঞ্চিৎ, অথবা একটু ঢিল দেয়া হয়, বয়সটা যে বেড়েছে। গোল বেড়ির ব্যাস তো সেই একই, চেপে  বসে বেড়ে যাওয়া মাংসে। ব্যাথা হয় আজকাল । কান্না তো ও শিশুর কাছে আজ বড্ড পুরাতন-অভিযোজিত। দিনে পর দিন পুরো সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা যার কাটে একা একা এইসব নৈমত্তিক দৃশ্যে, তার আবার কান্নার কি দরকার! কেবল ভাবনা জুড়ে চাকা আর চাকা তার-গোল গোল বৃত্ত, কালো রঙ; ঘুর্ণায়মান।

মাঝে চকিটা যখন ভেঙে গেলো, গোল গোল সাদা সাদা ঘুনে পোকারা মেঝেতে লুটোপুটি খেতে লাগল, সেদিন টের পেয়েছিল শিকলের টানে কি তীব্র যন্ত্রনা। চোখের জল তো বাধহীন, সে মানুষ মাত্রই। আর শিশুর তো কথাই নেই। শব্দও সাথে যোগদান করেছিল। আর সেটা না করলে কে এসে শিকলটা খুলে যন্ত্রনার হাত থেকে বাঁচাত! একে ব্যাথা তার উপর মা এসে বাজে ভাষায় বকাবকি করছিল- ‘একটুসখান চুপ কইরাও থাকবার পারসনা হারামী, অপয়া কোনহানকার। খালি যন্ত্রনা বাড়াইতে আইসছ। তোর চিল্লানী হোননের লাইগ্যা কি মরদরা আমর কাছে আহে রে? তোর লাইগ্যা বেসাতিও কমতে লইছে।’

শিশুটি কি বুঝেছিল কে জানে? বোঝার তো কথা নয়। কিন্তু কান্না সেদিন বেড়েই গিয়েছিল । বাড়ছিল ক্রমাগত। পায়ে ভাঙা চকির চেরা কাঠের আচঁড়ে আঙ্গুল চারেক ছড়ে গিয়েছিল, কেউ দেখেনি। মা-টাও না। সময় কোথায় এখানে এই পেট পূজোর ব্যস্ততায়। শিকলটা খুলে উঠোনে একটা পরিত্যক্ত ভ্যানের উপর নিয়ে যেতে যেতেও মা বকছিল-‘আর যদি লাফালাফি করছস , এক্কেরে ঐ ট্রেনের চাকায় তলে ছুইড়া ফেইল্যা দিয়া আসুম।’

চাকার কথা অনেকক্ষণ সে ভুলে ছিল। না চাকা অভিমান করবে! চাকাই তো তার জীবন । মায়ের ঘর থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ চ্যাঁচিয়ে উঠল- ‘ঐ খানকি মাগী, কই গেলি, ট্যাকা না দিয়াই যামু গা কইলাম’। সে যেন এক অমোঘ ডাক; মা তার ছুটে চলে গিয়েছিল সেই রোদ গিলে খেতে আসা ছায়ায় ছেলেটাকে ফেলে। রোদ দ্রুতই ছায়া খেয়ে ফেলেছিল। শিকলের বাঁধনটা ছিল ভ্যানের চাকার সাথে। গোল চাকা। রোদের কষ্ট , কান্নার শুকনো জল সব মিথ্যে শিশুর গোল চাকার প্রতি ভালোবাসায়। তার শিশু মন একবার ভেবেও ফেলল-সত্যি কি চিল্লাচিল্লি করলে মা ঐ চাকার তলে ফেলে দিয়ে আসবে? চাকার সাথে বন্ধুত্ব হবে। চাকার সাথে চলে যাওযা যাবে দুর থেকে দূরে। তারপর মনে পরে দু’দিন আগে কান্না করছিল। না কেঁদে কি উপায়, হাগু করার বালতিটা চকি থেকে পড়ে গেলো। কতক্ষণ চেয়ে রাখা যায়। মাদুর থেকে বিশ্রি গন্ধ ছুটে আসছিল নাকে। সময়টা ছিল বিকেল। বেশ্যা বেসাতির জমজমাট ক্ষণ। পাশের ঘরের সোনালী বু’র মা এসে টপাটপ দুটো চড় দিয়ে থামিয়ে দিয়ে গেলো। মা কান্না নাকি সেই চড়ের শব্দ শুনে শাড়িটা উদাম গায়ে জড়াতে জড়াতে ছুটে এসেছিল। কিন্তু সে যে সোনালীর মাকে অভিনন্দন জানানোর আশেই। ‘দে, দে আরও দুইটা দে, এক রত্তি চুপ থাকবার পারেনা হারামীডা। মরদগো কি ঠেক্যা পড়ছেনি ট্যাকা দিয়া এই প্যানপ্যানি শুনবার আইবো?’

‘মা, আমি চাকার সাথে চইল্যা যামু, আমারে চাকার কাছে দিইয়্যা দাও।’ মুখে বলার সাহস হয়না। শিকল বন্দী নিঃসঙ্গ শিশু । মস্তিষ্কে সাহস নামের কোন বস্তু কে এসে দিয়ে যাবে তাকে, এ যে সঞ্চয়ের জিনিস। এ যে চাকার মত ঘুরতে ঘুরতে ধুলো মেখে নেয়ার মত গায়ে। অথচ সোনালী বু মাত্র বছর দেড়েকের বড়। তার কত আদর। রোজই কোন না কোন খালা মামা তারে নিয়ে যাচ্ছে; তার মার ব্যবসার সময়টুকুতে তাদের কাছেই আদরে আদরে বড় হচ্ছে। গায়ে গতরে বাড়ছে। রঙ উজ্জ্বল হচ্ছে। প্রতিদিন কত মজার মজার চকলেট পায় সে। সেদিন সোনালী বু তাকে এসে দুটো চকলেট দিয়েছিল। সোনালী বু বলেছিল ট্রেনে থেকে হকার নেমে তার মার ঘরে ঢুকেছিল সেই লোকটাই তাকে চকলেট দিয়েছে। ...তার মার ঘরে কেনো চকলেট ওয়ালা ঢোকেনা! হয়তো ঢোকে, সে ছেলে বলেই চকলেট দেয়না হয়তো। মেয়ে শিশুর কেনো কদর সে অত বোঝেনা কিন্তু একদিন তার কানেও এসেছে সোনালী রূপ নিয়ে নানা প্রশংসা। একদিন নাকি সেও একটা ঘর পাবে, তার নাকি জমজমাট পসরা বসবে। অথচ কালো দেহটা তার রোদে পুড়ছে, সে আরও কালো হচ্ছে। দেহের কালো একদিন মনেও ছড়াবে। সেদিন এক দালাল মামু এসে কইল, ‘এই পোলাডাই একদিন সোনালীর দালাল হইবো দেইখ্যনে।’ দালাল হয়ে কি হবে সে বোঝেনা , চাকার সাথে যাওয়া যাবে কিনা সেরকম ভাবনায় ডুবে যায়। চাকার সাথে চলে যাবে ডোবার কিনারা ঘেঁষে, এইসব শিকল, চকি উঠোন মাদুর সব ছেড়ে চলে যাবে, মিষ্টি মিষ্টি চকলেট কিনে নেবে সে, চাকাই চিনিয়ে দেবে দোকান। কিন্তু মা! মা যে সারাদিন বকাবকির পরে রাতে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে দেখে মা কাঁদে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে...

ছোট এই পৃথিবী তার। বারান্দা উঠোন, ডোবা, রেললাইন, বড় রাস্তার পিচ আর কেবল চাকা আর চাকা। কু ঝিক ঝিক শব্দ কানে আসে। চোখের গোল ছিদ্র গুলো এক একটি চাকা বনে যায়। ট্রেনের চাকা একটা চলে যায় সামনে আরেকটা চলে আসে। চলে যেতেই থাকে একের পর এক সবগুলো। ঐ তো দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। মুগ্ধতা জাগে। আবার কখন চাকা আসবে। ঘুরবে, এগোবে সামনে। কোত্থেকে চাকা আসে কোথায় যায়? ট্রেন চলে গেছে। বড় রাস্তায় চাকা এক যায় সাথে সাথে আরেক আসে। বড় বড় চাকা। মাঝে কোনটার ফাঁকা। কোনটায় স্টিলের নকশা করা। সূর্যের আলো ঝিলিক দিয়ে তার চোখটা বন্ধ করে দেয়, সেই সুযোগে কয়েকটা চাকা মিলিয়ে যায়। সেগুলো আর দেখা হলোনা।

চাকার উপের ভ্যানের পাটাতন। প্রায় সপ্তাহখানেক বসে থাকতে হলো এর উপরেই। চাকাগুলোর সাথে রোজ কথা বলতে বলতে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে শিশুটার। চাকাগুলো বলেছে তাকে বহদূর দূরান্তে যাওয়া যায় চাকার সাথে। সে চাকার সাথে যেতে চেয়েছে। কখনও সে চাকাই হতে চেয়েছে। নতুন চকিতে এসে আর ভাল লাগেনা। ক’দিনের ভ্যানের চাকা- তাও এখন দূরে। আরও এক সপ্তাহ পরে সে ভ্যানটিও উঠোন থেকে কে জানি নিয়ে চলে গেলো। চোখ দিয়ে শিশুটির দু;ফোঁটা জল ঝরে পড়ল।

চাকার আবিষ্কারের ভিত্তিতে চড়ে সেই অসভ্য সভ্যতা এই প্রযুক্তিময় সভ্য সভ্যতায়  এসেছে, এ তথ্য এ জ্ঞানহীন শিশুর জানার কথা নয় মোটেও। তবুও সে চাকাই চিনেছে। সে চাকার প্রেমেই মত্ত। তার চার বছরের জীবনে চাকা ছাড়া আর কিইবা আছে।

কালো দেহটা দুটো ভাগ হয়ে গেছে। কতটুকুইবা আর দেহ ছিল, তাও দু’টো ভাগ। রক্তে মাখামাখি। বিচ্ছিন্ন দেহদুটো কেউ একজন একসাথে করে ডোবার এপাশে উঠোনে এনে একটা মাদুরে শুয়ে দিয়েছে। সে লাশের দিকে তাকিয়ে কে যেন বলে উঠল, ‘যা মরে বাঁচলি, মা-খালা-বোনের দালালি তো করতি হইলোনা।’

সকাল থেকেই পুরো পাড়ায় উৎসবের আমেজ। নতুন দু'টো মেয়ে সাবালিকা হয়েছে। দুটো নতুন ঘর পেয়েছে সে দু’জন। দামী খদ্দের আসবে। প্রথম বেসাতি হবে। আজ উৎসবের আয়োজনে শিশুটির মার মনও টানছিল। ওদিকে আবার সাত সকালেই এক বান্ধা কাস্টমারের আগমন। সব দিকে তাড়াহুড়া। শিকলটা তাড়াহুড়াতেই কোনমতে চকির পায়ায় বেঁধেছিল। তালা লাগায়না একটা কাপড় দিয়ে বাঁধে। রোজ সেটাই করে। মা তখন ঘরের ভেতর বান্ধা খদ্দেরের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত। উৎসবের রঙ মাখামাখিতে যাবার জন্য কে যেন শিকলের বাঁধনটা খুলে দিয়ে গেলো। শিশুটা তার পিছে পিছে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো। সেতো পথ চেনেনা। তার চেনা টুকু ঐ তো কেবল ডোবা, ট্রেন লাইন, তারপর বড় রাস্তা। সেদিকেই সে উল্টো ঘুরে হাঁটতে থাকে। ঐ তো বড় রাস্তায় বড় বড় চাকা দেখা যায়। ট্রেনের শব্দটা শুনতে পায় তখনই। এবার দৌড়ানোর পালা। আজ সে ট্রেনের গোল গোল কালো কালো চাকাগুলো ছুঁয়ে দেখবেই। ছুঁতে তাকে হবেই। কিন্তু তারপর...সব শেষ, চাকাগুলোই উল্টো ছুঁয়ে গেলো তার নরম-কোমল,জীর্ণ-রুগ্ন কালো দেহটা।

 মা’টা তার কাঁদতে চায়নি। কিন্তু চোখ মানেনা। মনের ভেতর থেকে মাতৃত্ব  নামের এক ভূ-তাত্ত্বিক জীবন সুধা হতে ক’ফোটা জল বেরিয়ে এসে চোখ হতে গড়িয়ে পড়ে। সে জীবন সুধার মাঝে আটকে থাকা একটা দীর্ঘধ্বনি মাতমের শব্দ হয়ে কণ্ঠ হতে ঠিকই বেরিয়েও আসে।  তারপর খানিকটা সময় পর সব মিটে যায়। মনে মনে বলে-‘ হে ঈশ্বর , এর পর কোন সন্তান হইলে যেন মাইয়্যাই হয়।’ এই পতিতালয়ে মেয়েদের পালার মানুষ আছে, মেয়ে পন্যই তো কেবল বিকোয়।

তার হাতে কে যেন রক্ত মাখা গোল চাকার মত শিকল বেড়িটা ধরিয়ে দিয়ে যায়। সেটা উঠোনে রাখতেই কেউ একজন ছো মেরে নিয়ে গেলো। চিনল , তারই মত আরেক পতিতা, ওর ঘরেও একটা ছেলে আছে। বয়স বছর খানেক।

২টি মন্তব্য: