মামুন ম . আজিজ
॥এক॥
এ হলো সমতল ঢল। আগে মাঝে মাঝে নামতো। আজকাল তো অহরহ।
পাহাড়ি ঢল নামে,পানির
তোড়ে ভেসে যায় পাহাড়ি মাটি সাথে মাটির উপরের কতকিছু। পানি উপর
থেকে নিচে নামতেই পারে,তরল আর গতির ধর্মই
ওমন। অথচ সমতল এই ঢলের কোন ধর্ম নেই। এ পানির ঢল না। এ সভ্যতার বিস্ফোরন। এ
ঢলে মাটি ভাসে না,তবে এই শহরের কোটি
কোটি মানুষের মনঃসুখ ভেসে যায় রোজ। ঢাকাবাসির জীবনের মূল্যবান সময়গুলো রাস্তায় গরমে ধুলো আর ঘামের সাথে নিবিড় সখ্যতায় অকারনেই উচ্ছন্নে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। অথচ কোন সমাধান নেই। দিন দিন কেবল বেড়েই চলেছে বাস গাড়ী আর রিকশার ঢল,মানে নিদারুন জ্যাম।
কোটি মানুষের মনঃসুখ ভেসে যায় রোজ। ঢাকাবাসির জীবনের মূল্যবান সময়গুলো রাস্তায় গরমে ধুলো আর ঘামের সাথে নিবিড় সখ্যতায় অকারনেই উচ্ছন্নে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। অথচ কোন সমাধান নেই। দিন দিন কেবল বেড়েই চলেছে বাস গাড়ী আর রিকশার ঢল,মানে নিদারুন জ্যাম।
দেখতে দেখতে এসব সয়ে গেছে চোখে সবার। কিন্তু মনের কষ্ট কি
আর সহ্য হয়! কষ্ট আজ জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে।
শাহবাগের মোড়ে চারদিকে চলে গেছে চারটি রাজপথ। এই শহরের রাস্তাগুলোর তুলনায় কোনটিই
ছোট নয় তেমন। দু’দিকে আবার রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে
ইদানিং। ভেরি ভেরি ইমপর্টেন্ট রোডের স্বীকৃতি পেয়ে রিকশার এই দুর্গতি। এ নিয়েও
বিতর্ক । কেউ বলে রিকশাই যত জ্যামের কারন। আর কেউ বলে গাড়ীর অবিমৃষ্য ক্রমবৃদ্ধিই মূল কারন এ সমতল ঢলের। কিন্তু দুটোই
সত্য। এ শহরে গরীবের সংখ্যা যত গাড়ীর সংখ্যা তার চেয়েও বেশী হয়ে গেছে আজ। ঐ যে ৮০ শতাংশ সম্পদ ২০ শতাংশের
হাতে ধরনের একটা থিউরী আছে না! সে তো মহাসত্য এই মেগা সিটির জন্য। তার উপর সেই ২০
শতাংশ মানুষের ৮০ শতাংশ আবার পুরো দেশের বিস্তৃত জনপদ ছেড়ে এই গলি ঘুপচির ছোট্ট
শহরেই তো গেড়েছে আস্তানা।
বিকেলের শেষাংশে ঘরে ফেরার তাড়ায় সমতল ঢলে বাড়তি জোয়ার এসে
গেছে। প্রতিটা সিগন্যালে গাড়ীগুলোকে মিনিট দশেক ও বসে থাকতে হচ্ছে নিথড়-অসার। এই অসহ্য ঢলে অধিকাংশের নাভিশ্বাস শুরু হয়ে গেলেও ব্যস্ত হয়ে ওঠে
একদল নিম্ন শ্রেণীর মানুষ। তারা নানান শারীরিক, মানসিক
কিংবা বয়োবৃদ্ধি জনিত অসংগতি নিয়ে বেঁচে থাকা
ভিখিরির দল আর ফেরিওয়ালা।
তিনদিকে থেমে আছে সমতল ঢল। উপচে পড়া গাড়ী আর রিকশা একটার
সাথে আরেকটা যেন ফেভিকলের আঠা দিয়ে লাগানো। এরই মাঝে দুটো জীর্ন মেয়ে জীবিকার টানে
এগিয়ে চলেছে এ গাড়ী থেকে ও গাড়ীর জানালার কাছে।
হঠাৎ একটা কাঁচ ভাঙার মত শব্দ। অল্প সময়। গাড়ীর ভোঁ ভোঁ
আওয়াজের মাঝেও শব্দটা দু’জনের কানে ঠিকই পৌঁছালো। সাথে সাথে চোখ ফেরালো দু’জনেই শব্দটার উৎসে।
চারটে চোখ ঘুরেছে কিন্তু দুইজনের হাতই তখনও শক্ত করে ধরে
আছে অন্য জনের উসকো খুশকো চুলের মুঠো। কাড়াকাড়ি নিয়ে তাদের মধ্যে চুলোচুলিটা শুরু
হয়েছিল সবেমাত্র। ট্রাফিক সিগন্যালের একদম সামনের সারিতে লাল গাড়ীটা দাঁড়িয়েছিল। সেদিকে লক্ষ্য করেই
তারা দুজন ছুটে গিয়েছিল। লাল টুকটুকে গাড়ীটার জানালা খুলে দশ টাকার নোটটা বাড়িয়ে
দিয়েছিল সুন্দরী মেয়েটা কলমির দিকেই। কচকচা দশ টাকার নোটটা হাতে পেয়ে কলমির মুখে
ধরেছিল বাধ না মানা হাসি। সে হাসির আবেশ ছড়িয়ে পড়েছিল একই সাথে জানালার কাচে হাত
বাড়ানো সমবয়সী অনবদ্য সঙ্গী আলতা নামের ত্রয়োদশী মেয়েটার চেহারাতেও। ভেবেছিল পাঁচটা টাকা তো অন্তত পাবে সে। ভাবতেই পারে। এর আগে এরকম এক টাকা দু’টাকা কত ভাগভাগি করে নিয়েছে দু’জনে। কিন্তু কলমি দিতে
চাইলনা কিছুতেই। আলতা ক্ষিপ্ত হলো। পাঁচ টাকা বলে কথা। ছেড়ে দেয়া যাবে না।
‘দে কইতাছি। দে ছেমড়ি। দে। ’
‘না দিমু না। লাল আফায় আমারে দিছে। তোরে দিছে নি। আমারে হের পছন্দ হইছে,হের
লাইগ্যা দিছে। তোরে দিমু ক্যা?’
আলতা রাগে ফুঁসছিল। কথায় কাজ হচ্ছেনা দেখে হাত বাড়িয়ে
ধরেছিল কলমির চুলের মুঠো। সুবিধা করতে পারছিলনা । কলমির টাইফয়েড হলো সেই যে গতবছর, এর পর
চুল সব পড়ে গিয়েছিল। একদম সব। পুরো মাথা ন্যাড়া হয়ে গেলো । এখন অবশ্য কানের নিচ
পর্যন্ত নেমেছে ময়লা মাখা চুলের গোছা। কলমিও কম যায় না। সেও সাথে সাথে হাত বাড়িয়ে
আলতার চুল ধরেছিল । ঘাড়ের অনেক নিচে পিঠের উপর পরে থাকা অপরিপাটি ধুলো মাখা চুল গুলো তার। জট হয়ে আছে।
চুল টানাটানিতে কলমিরই অবস্থান ছিল তাই সুবিধাজনক। চুল না
থাকলে কি হবে ফর্সা মুখের দ্যুতি ভীষণ আকর্ষণীয় কলমির ।
লালগাড়ীর মধ্যে বসে থাকা তথাকথিত সুন্দরী স্মার্ট আপাদের দৃষ্টি কে বেশী আকর্ষন
করে সেই দ্যুতি। সে দুত্যির আকর্ষন আলতার মিচমিচে কালো মুখের
নিষ্প্রভার চেয়ে অনেক অনেক বেশী। টাইফয়েডে কলমির মুখের অবয়ব আর হাড় মাংস শীর্ণ হয়ে
গেলেও বাড়িয়ে দিয়ে গেছে চেহারায় মাধুরতা বহুগুনে। বড়লোকদের সহানুভূতির জন্য সেটাই
যে অনেক প্রয়োজন।
॥দুই॥
চুল টানাটানির খেলা দেখতে শত চোখ যখন তাদের দিকে নিবিষ্ট
তখনই শব্দটা কানে এল। দু’জন এক সাথেই তাকিয়ে দেখল প্লেটটার ভাঙা একটা টুকরো পাকা রাস্তায় বাড়ি খেয়ে
শূণ্যে লাফিয়ে উঠছে। অর্ধেকটা প্লেট অক্ষত অবস্থায় পড়ে আছে শাড়ী পড়া তরুণীটির
পায়ের কাছে । চটপটির বেশীর ভাগই সে ভাঙা অংশে তখনও সতেজ। শাড়ী ঝাড়তে ব্যস্ত
মেয়েটা। তীব্র বিরক্তি তার চোখে মুখে।
যার হাতের কনুইয়ের সাথে ধাক্কা লেগে তরণীটির হাত থেকে চটপটির প্লেটটা পড়ে গেছে সে লোকটা দিব্যি হেঁটে চলে যাচ্ছে।
হাঁটার গতিতে মনে হচ্ছে ধাক্কাটা ইচ্ছাকৃতও হতে পারে। সুন্দরী নারীর ছোঁয়া পাবার
এই বিকৃত মানসিকতা এক গোপন রোগ হয়ে সমাজে টিকে আছে দীর্ঘদিন। তরুণীটার সাথে থাকা
যুবকটি মেজাজের ভঙ্গিতে তাকালো ঐ লোকটার দিকে তারপর তিরিক্ষি স্বরে বলল, ‘হাই ইউ!’ তার কানে
কি আর সে ধ্বনি পৌঁছায়?
দূরন্ত গতিতে রাস্তা পার হয়ে ওপারে পিজি হাসপাতালের সামনের
লোকারণ্যে সে তখন দৃশ্যমান অদৃশ্য।
আলতা আর কলমী
একসাথে দৌড়ে গেলো। এবার আলতাই পৌঁছালো আগে। ‘আফা ওই টুকু আমি খাইয়া ফেলাই।’ বলে কোন দেরি নয়,চিলের মত
ছোঁ মেরে ভাঙা প্লেটটা হাতে নিয়ে ধুলো ময়লা
মাখা চটপটি গপাগপ গিলতে লাগল সে। ততক্ষণে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে
কলমিও। তারও ভীষণ লোভ হচ্ছে। চেয়ে দেখল অন্য একটা ভাঙা টুকরোয় কিছু চটপটি এখনও অবশিষ্ট হয়ে
লেগে আছে। নিচু হয়ে যেই তুলে আনতে গেল।
দোকনদার লোকটা কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল, ‘অ্যাই! সর সর।’
কলমি বলল,‘ আফা, আমি
পরিষ্কার কইরা দেই। দুইটা টাহা দিয়েন। ’
শাড়ী পড়া তরুণীটা আদেশের সুরে পরিষ্কার করতে সায়
দিল।
দোকানদারের চেহারায় উৎকণ্ঠা ফুটে উঠতে শুরু করেছিল।
প্লেটটার তো একটা মূল্য আছে। যুবকটি সে উৎকণ্ঠা টের পেয়ে বলে উঠল সাথে সাথেই,‘চিন্তা করেন কেন ভাই। প্লেটের দাম দিয়ে দেব। ওই মেয়েটারেও আমি দুই টাকা দিয়ে
দেব। আপনি আরেক প্লেট চটপটি বানান। ’
‘না দিলে তো স্যার আমার আসলে লস
হইয়া যাইব। আমি গরীব মানুষ বোঝেন তো। ঝুঝতাছি আপনাদেরও কোন দোষ নাই । তবুও আমার
কয়টাকা আর লাভ হয়। আমি গরীব চটপটিওয়ালা; বোঝেনই তো স্যার।’
কলমি ততক্ষণে ভাঙা টুকরো গুলো জড়ো করে ফেলেছে। আলতা দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে তখনও গিলছিল ধূলো মেশানো চটপটি। এবার ডাকল, ‘কলমি নে তোর লাইগা রাখছি।
খাইয়া ল।’ দু’জনের সখ্যতা যে অকৃত্রিম।
‘খাড়া আইতাছি।’
কলমির চেহারাই শুধু না কণ্ঠও বেশ মিষ্টি। শাড়ী পড়া মেয়েটার
চোখে আটকে গেল ওর ফর্সা ধবধবে সুন্দর মুখটার দিকে। বলল,‘আই মেয়ে কি নাম রে তোর?
আচ্ছা নাম যাই হোক...দে তো, একটু পানি দিয়ে ধুয়ে দে তো আমার
শড়ির এই জায়গাটুকু।’
কলমি দোকান থেকে
একট গ্লাসে পানি নিয়ে মেয়েটার শাড়ির মধ্যে লেগে থাকা চটপটির দাগ টুকো ধুয়ে দিতে
লাগল। মেয়েটা দোকানদারকে বলল,‘ আরেকটা
প্লেট চটপটি বানান তো এই মেয়েটার জন্য’
শাড়ি পরিষ্কার শেষ করে প্লেটটা হাতে নিয়ে কলমি ছুটে গেল
আলতার পাশে। কোথায় সেই চুল টানাটানি। দু’জন সেই চটপটি ভাগাভাগি করে
খেতে লাগল। একটা সম্পূর্ন চটপটির প্লেট, কোন এঁটো নয়,উচ্ছিষ্ট
নয়। এ আরাধ্য ভাগাভাগি না করলে যে তাদের জীবনের সব সখ্যতাই বৃথা।
যাবার সময় শাড়ি পড়া মেয়েটা কলমির হাতে গুজে দিয়ে গেল দশটি
টাকাও। চোখে পানি এসে গেল কলমির।
চেটেপুটে গোগ্রাসে
গিলে প্লেটটা ফেরত দিয়ে দুজনে হেঁটে হেঁটে এসে দাঁড়ালো রাস্তার ওপাশে ফুলের
দোকানগুলোর সামনে। মাঝে মাঝে এখান থেকে ছেড়া ঝরে পড়া গোলাপ ফুল কম দামে কিনে নিয়ে
রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বিক্রি করে ওরা। কখনও বিক্রি করে বকুল ফুল কুড়িয়ে
মালা বানিয়েও। এখন ফুলের দাম বেশ চড়া। তাই ওসব ব্যবসা আপাতত বন্ধ।
সব সময় ওরা ভিক্ষা
করেনা। ফুল না পেলে চকলেট বিক্রি করে। বিনা পয়সায় কোন দোকানদার ফুল দেয়না, চকলেট ও
না। তাই যেদিন টাকা থাকেনা ভিক্ষাই হয় একমাত্র উপায়।
॥তিন॥
কলমি আর আলতা একই বস্তিতে থাকে। বাধের ওপারে। ওদের দুজনের
মধ্যে ঝগড়া যেমন নিত্য,
বন্ধুত্বও তেমন প্রানবন্ত। শাহবাগের এই মোড়ে কদাচিৎই তাদের
বিচ্ছিন্ন দেখা যায়। ঝগড়াঝাটিটা যেমন তারা কেবল নিজেদের মধ্যেই শেয়ার করে তেমনি
শেয়ার করে মুঠো দু মুঠো খাবারও যখন যেমন জোটে।
রমনা পার্কের ভেতর ওদের বস্তির আদুল মিয়ার ভ্রাম্যমান
দোকান। সকালে বস্তি থেকে বের হবার সময় তার কাছ থেকেই ওরা চকলেট কিনে আনে। যেদিন
বিক্রিবাটা বেশী হয় তখন কখনও কখনও রমনা পার্কে আদুল মিয়ার দোকানে গিয়েও নিয়ে আসে ।
সচারচর এক প্যাকেট চকলেট বেচতেই ওদের সন্ধ্যা হয়ে যায়। এক প্যাকেট চকলেট বিক্রি
হলে লাভ থাকে বিশ পঁচিশ টাকা মাত্র। যেখানে ভিক্ষা করলে মুহূর্তে
পাওয়া যায় এর বহুগুন,কখনও কখনও দশ টাকা বার আরও
বেশি। তবুও ভিক্ষা করতে তাদের দু’জনের খারাপই লাগে।
আজ উপায় ছিলনা। আগের দিন আদুল মিয়া বাকীতেই চকলেট দিয়েছিল।
সে টাকাই শোধ করা হয়নি। আজকে তাই আর বাকী চাওয়ার
সাহস পায়নি।
গত পরশুদিনের কথা। দুজনের কাছে ভালো
অংকের টাকাই ছিল। কিন্তু থাকলে কি হবে? গরীবের কপাল গরীবের মতই। কলমির মাতাল বাবা কলমির কাছে সে টাকা দেখে
ফেলেছিল। বাবর সাথে কলমি পারবে কি করে! বাধ্য হয়ে সে টাকা
বাবার করায়ত্ব হলো তার মাতলামির বিষজল কেনার জন্য। আর অন্যদিকে আলতার মা’র বেড়েছিল সেই গোপন রোগটা। মার জন্য তাকে ওষুধ কিনতে হয়েছিল। না হলে মা যে
যেতে পারতনা বাসা বাড়ীর বুয়ার কাজে।
আলতার বাবা গ্রামে আরেকটা বিয়ে করেছে। সেও অনেকদিন হযে
গেছে। বেশ ভালই ছিল ওরা। মোটামুটি ছোট পরিবার ছিল ওদের। বড়লোকদের মত মা-বাবা আর দুই
সন্তান। ওর বাপটা রিকশা চালাতো । মা কাজ
করতো ঝুটা বুয়ার। হঠাৎ কি যে অভিশাপ লাগল। মার হলো এই কঠিন রোগ । সারদিন পড়ে থাকে
বিছানায়। বাপটা একদিন চলে গেল। গেল তো গেলই। কোন দেখাই পাওয়া গেলো না আর তার। পরে
ওরা জেনেছিল বাপ গ্রামে ফিরে গেছে। আরেকটা বিয়ে করেছে। রিকশাওয়ালার সারাদিনের গা
গতরের খাঁটুনির পর রাতে দেহের আরাম দেহের আলিঙ্গনে পূরণই যদি না হবে সে বউ তার
থেকে কি লাভ। তার দর্শন হয়তো ওমনই। ওখানে ভালোবাসা আবার কোন
চুলোর জিনিস!
বাবার বিয়ে জনিত খোঁজ যখন জানল তার কিছু দিন আগ থেকে মার রোগটা ভাল হতে শুরু
করেছিল। কিন্তু পুরাপুরি ভাল হলোনা। ডাক্তার খরচ কে দেবে? তবুও
একটু সুস্থ হতেই মা কাজ নিল আবার। আগের
পরিচিত এক বাসা। ঝুটা বুয়ার কাজ করত। এখন পাকাপাকি ব্যবস্থা। ওখানেই থাকে। আলতার
সাথে মার দেখা হয় কদাচিৎ। রোগটা তার মার পুরাপুরি ভাল হয় নাই। আলতা সেটা জানে।
মাঝে মাঝে পেটে ব্যাথা উঠলে বস্তিতে মেয়ের কাছে আছে মেয়েকে দেখার নাম করে। তখন সেই
ওষুধটা খেলে সুস্থ হয় মোটামুটি। অনেক আগে ডাক্তার ঐ ওষুধ দিয়েছিল। তখনতো বাপটা
তার কষ্ট হলেও ডাক্তার দেখাত । কত ভালা মানুষ ছিল বাপটা। কিন্তু এখন সে
বোঝে সে ভালো মানুষি রূপটাও একটা দেহের মোহেই শুধু…তারপর আশা শেষ,মানুষও শেষ।
মেয়ের নিয়ে আসা ওষুধ খেয়ে মা তার
সুস্থ হয়ে আবার ফিরে যায় কাজে। নিজের খাবার আর ঘর ভাড়া তাই নিজেকেই যোগাতে হয়
আলতার। ছোট যে ভাইটা ছিল তাকে মা একদিন মেরে ছিল ভীষণ। সেই থেকে রাগ করে সে ঘর
ছাড়া। খবর পেয়েছিল সে চিটাগাং আছে । আদুল মিয়ার দোকানের
কর্মচারী দুলাল বলেছে সে তাকে দেখেছে ওইখানে। জাহাজ কারখানায়
কাজ করে। সে কথা জানার পর আলতা মনে মনে ভেবেছিল যাক হয়তো সেই
জাহাজের কাজ করতে করতে একদিন জাহাজে চড়ে বিদেশেই চলে যাবে তার ভাই। বিদেশে নাকি
মহাসুখ! ভাইয়ের সে সুখের ভবিষ্যত জল্পনা করে নিজেও একটু
সুখের ক্ষণিক আবেশে মনটা ভরিয়ে তোলে সে।
দুলাল ছেলেটা এই বস্তিরই বাসিন্দা নয়। থাকে ঢাকার অন্য
প্রান্তে। যথেষ্ট কর্মঠ ছেলে। গায়ে গতরে ভালো খাটতে পারে। দুলালের সাথে আলতার বেশ
খাতির। দরিদ্র পরিবেশের ইঁচড়ে পাঁকা আলতা দুলালকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। ভাবে দুলালও ওকে বেশ পছন্দ করে। কিন্তু দুলালের
মনের কথা সে বুঝবে কি করে! ও কি আর জানে দুলালের পছন্দ আসলে কলমি। কলমির সাথে
খাতির করা উদ্দেশ্যই আলতার সাথে তার এই মেলামেশা। কলমির যে রূপ তাতে ওর পাশে কালো
গায়ের বর্ণে আলতাকে ঠিক যেন মনে হয় চাঁদের পাশে মৃয়মান অমাবশ্যা।
কলমি অবশ্য দুলালকে এক বিন্দুও দেখতে পারেনা। কথা তো দূরে থাক তার দিকে তাকানোর প্রয়োজনই সে বোধ
করে না কখনও। দুলাল সেট যে বোঝেনা তা নয়, তবুও দুলালের ধৈর্য্যর সীমা শেষ
হয় না। সে অপেক্ষা করবে বলে মনে মনে স্থির সংকল্প
তার। তাই কলমিই তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর একমাত্র অবলম্বন। কলমিই তার
অপছন্দের মাঝেও নিবিড় প্রয়োজনীয় বন্ধুই যেন। তার উপর কালো
হোক আ অপছন্দরেই আলতাও তো একটা মেয়েই। দুলাল সেটাও মনে ভীষন দৃঢ়ভাবে পোষন করে চলে
হয়তো।
॥চার॥
পশ্চিমাকাশে লাল আভা ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে। সূর্যের শেষ
চিহ্ন টুকু বিলিন হয়েছে একটু আগেই। আঁধার তার আধিপত্য বিস্তার করতে চলে এলো বলে
প্রায়। সেই আলো আঁধারিকে মনে লালন করেই দু’টি পথমেয়ে হাঁটছে। হাঁটতে
হাঁটতেই কলমি আর আলতা পায়জামার কোচর হতে টাকার নোট গুলো বের করে গুণে দেখল। বেশ
ভালই জমেছে। কলমি বলে উঠল,
‘আমার ৪০ টাকা হইছে আলতা তোর কত রে?’
‘আমারও অনেক, চল আদুল মিয়ার টাকাটা শোধ কইরা দিয়া আহি। হালায় সকালে বহুত চেল্লাইছে।’
‘ল । চল।’
আদুলের দোকানের উদ্দেশ্যে যাত্র করল দু’জন। রাস্তা পার হয়ে উত্তর পার্শ্বে যাওয়ার জন্য পা বাড়লো আর সিগন্যালটাও পড়ল তখন। তাদের ঠিক সামনের রিকশাটায় এক ভদ্র মহিলা আর সাথে তার মেয়ে বসে আছে।
মেয়েটার বয়স ১৭/১৮ হবে। তার দিকে হাতটা পাতল কলমি। আর আলতা হাত পাতল রিকশার পেছনে
একটা সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কারের জানালায়। রিকশার মেয়েটার
কাছে কলমির মিষ্টি চেহারাটা বেশ পরিচিত। কলেজে যাবার সময় প্রায়শই সে ওকে দেখে।
মাকে বলল,
‘আম্মু, দেখেছ মেয়েটা কি সুন্দর। কি ইনোসেন্ট! দেখলেই মায়া মায়া
লাগে। প্রায়ই মেয়েটাকে দেখি এখানে। ওকে
বাসায় কাজের জন্য রাখা যায়না? ’
মা মনে হলো একটু বিরক্ত হলেন, পার্স খুলে কলমির হাতে পাঁচটা
টাকা দেবার জন্য হাত বাড়ালেন। মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, ‘আই তোর নাম কি? থাকিস কই
।’
‘কলমি গো আফা’ কলমি
টাকা টা নিতে নিতে উত্তর দিলো ।
মেয়েটা আবার জিজ্ঞেস করল, ‘তোর বাসায় কে কে আছে?’
মা বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘অত কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?’
কলমি ততক্ষণে উত্তর দিতে শুরু করে দিয়েছিল, ‘...আফা আমার বাড়ীত বাপ আছে আর সৎ মা
আর দুইটা ছোট ছোট ভাই। ’
সিগন্যাল ছেড়েছে। রিকশা ছাড়ল। মেয়েটা বলছে, ‘মা ওকে রাখা যায়না?’
‘নারে সিনথিয়া,চিনি না জানিনা। তার উপর ওত সুন্দর মেয়ে বাসায় কাজে রাখলে অনকে সমস্যা হবে।’
কলমি স্পষ্ট শুনল সে কথা।
যদিও রিকশা ততক্ষণে সামনে এগিয়ে গেছে । যেমন আনন্দ অনুভূত হলো তেমনি কষ্টও।
আলতা ছুটে আসছে। ওর হাতেও দু’টাকা।
কলমির হাতে পাঁচ টাকা দেখে এখন আর তার কেনো জানি মনটা খারাপ হলো না। দীর্ঘ
অভিজ্ঞতায় ওর জানা আছে জগতটা সুন্দরের কাছেই ছুটে যায়। তবুও কলমির চোখে হালকা
পানির একটা রেখা নেমে আসে। আপন দুঃখের সাথে সে দুঃখও মিশে যায় আলতার মনে।
রাস্তার সোডিয়াম বাতিগুলো জ্বলতে শুরু করেছে যদিও আকাশের এক
কোনায় এখনও হালকা আলোর ধূসর রেখা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। এখনও পুরোপুরি সন্ধ্যার
আঁধার ঘনায়নি। কিন্তু এলা বলে। ও জিনিস মুহূর্তে আগমনি জিনিসইতো। বারো তেরো বছরের দু’জন পথকন্যা রমনা পার্কের দিকে এগোতে লাগল রাস্তাটা পার হয়ে।
॥ পাঁচ॥
আদুল দোকান বন্ধ করার জন্য তৈরী হচ্ছিল। দুলালকে দেখা
যাচ্ছেনা। চলে গেছে সম্ভবত। সন্ধ্যার পরের সময়টাতে সে বসে থাকে না। একটা হোটেলে
ধোঁয়া মোছার কাজ করে। দুলাল ওদের বস্তিতেও থাকেনা। তাই ওকে দেখতে হলে এই আদুল
মিয়ার দোকানই আলতার জন্যে একমাত্র উপায় ।
আদুল মিয়ার চোখ আটকে ছিল কলমির বুকের দিকে। একে তো সদ্য
ফুটতে থাকা পয়োধর তার উপর ময়লা জীর্ণ জামাটার কাঁধের নিচেই ছিল একটা বড় ফুটো।
সন্ধ্যবাতির ক্ষনে লজ্জা লাগতে শুরু করেছিল কলমির বেশ। বয়স কম হলে কি হবে। বস্তির
সমাজে অকালপক্কতার যে বহতা ব্যাপক। সে ব্যাপকতা এই বয়সেই দেহ বিষয়ক অনেক কিছু
শিখিয়ে দিয়েছে তবে দেয়নি উঠতি দেহের লজ্জা সংবরণের যথার্থ আয়োজনের উপায়। দারিদ্রের
কাছে তারা সেখানেও পরাজিত। এই বয়সেই তারা জেনে ছিল বস্তির রত্না আর মালাবুকে কেন সং সাজা অবস্থায় সন্ধ্যার পরে পার্কের আশেপাশে দেখা যায়।
আলতা একদিন কলমিকে বলছিল একা নির্জনে পেয়ে দুলাল অনেকবাইর
ওর বুকে হাত দেয়ার চেষ্টা করেছে। বাধা দিয়েছে যদিও কিন্তু বেশ মজাও লেগেছে...
এসব জানে দেখেই হতো আদুল মিয়ার ওই কু-দৃষ্টিকে কু দৃষ্টিই
মনে হচ্ছিল। লজ্জা তো লাগবেই । জানলেই লজ্জা।
না জানলেই কি তবে ভালো ?
হাতের কাজ ফেলে আদুল মিয়া চেয়েই আছে। চোখ আর ফিরছেনা তার
অন্যদিকে।
কলমি আর আলতা দুজনেই একসাথে পাওনা টাকা বের করে হাত বাড়িয়ে
দিল। টাকা নিতে নিতেই হয়তো মনের মধ্যে দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল তার।
দুলাল আর আলতার ভাবের কথা আদুল মিয়ার অজানা নয়। আলতার দিকে
ফিরে তাই বলে উঠল, ‘আলতা একটা কাম কইরা দিবি?’
‘কি কাম?’
‘দুলালরে একটা কথা কইতে মনে নাই। ওয় যে হোটেলে কাম করে ঐটা চিনস না তুই?’
‘হঁ। চিনি। কেন?’
‘তুই হের কাছে গিয়া একটা খবর দিয়া আবি। হেরে কবি কাইল সকালে কাজে আহনের সময়
করিম মিয়ার দোকান হইয়া আসে যেন। কইলেই বাকীটা দুলাল বুঝব। এই ল দশটাকা। বোইন ভালো
আমার, যা। দৌড়াই যাবি আর দৌড়াই আবি। আবার কথায় মইজা যাইসনা।’
আলতা তো মনে মনে খুশি। এক পায়ে খাড়া। ও যে দুলালকে সত্যিই
পছন্দ করে। মনে মনে ভেবে রেখেছে তাকে নিয়ে সংসার করবে। সুখের সংসার। ওর বাপ মায়ের
মত মিথ্যে মায়ার দেহ সর্বস্ব সংসার নয়। খুশিটা যটা সম্ভব ছাই চাপা দিয়ে কলমির দিকে
ফিরে বলল
‘চল কলমি ।’
‘তুই একা যা। পারবিনা। কলমি আমার লগে একটু গোছগাছের কাম কইরা দিবোনে। তাড়াতাড়ি
চইল্যা আসিস। সবাই একলগে বাড়ীতে ফিরমুনে।’
সরল বিশ্বাস মনে মনে হাসতে হাসতে চলে গেল আলতা। আর কলমি
দাঁড়িয়ে রইল।
॥ছয়॥
‘কি করতে হইব আদুল ভাই।’
‘ভাই কছ কে? এদিকে আয় কাছে আয়।’
‘আপনের ভাই কমুনা তো কি কমু ? ’
সে কথা কানে তোলার সময় কই তখন আদুল মিয়ার। অন্ধকার আদুল
মিয়ার বন্ধু হয়ে গেছে পুরোপুরি। চারদিকে আঁধারের চাদর। বহুদিনের লালিত বাসনা
পূরনের অবাধ সুযোগ আজ তার। আলতার ফিরে আসতে বেশী সময় লাগবেনা সে জানে। দেরী করা
মোটেও ঠিক হবেনা। ঘরে তার একটা বউ আছে। আছে একটা ছোট বাচ্চাও। তাকে অবিশ্বাস করার মত কোন কারনই কলমির মনে
আসার কথা নয়। কিন্তু কলমি কি জানে তার সুশ্রী রূপ ই তার বড় শত্রু? সে শত্রু আদুলদের
মত কপট নরপশুর সাথে আতাতে কোন মুহূর্তই নষ্ট করে না।
তিরিশ বছরের শক্ত সমর্থ যুবক আদুল। কালো কালো লোমে ঢাকা
কালো লোহার মত হাতটা তার। কলমির কোমল হাতের বাঁধা তাকে কি আর রুখতে পারে!
প্রথমে চিৎকার দিয়েছিল। লোমশ হাতখানি আদুলের সে মুখে চেপে
ধরতেই চিৎকারের শব্দ থেমে গেলো। কলমি ছটফট করতে করতে কিছু বুঝে ওঠার
আগেই ঘটে গেলো অনেক কিছুই। পায়জামাটা
একটানেই খুলে ফেলেছিল আদুল। কোচরের টাকা আর পয়সাগুলা লুটোপুটি খেতে লাগলো কচি
আঁধার মেশা ঘাসে। জীবনে প্রথম কোন পুরুষের কামনার বিষ ছড়িয়ে পড়ল তীব্র যন্ত্রনায়
কলমির রন্ধ্রে রন্ধ্রে মুহূর্তে। আচমকা এক ঝড় এলা যেন। ঝড় থামতেই পুরো শরীর বিকৃত
যন্ত্রনায় চুপসে গেলো একটা শিশু মন নিজের ভেতরেই।
লুঙ্গিটা কোমরে জাড়াতে জড়াতে আদুল বলছিল,‘ ভয়
পাইতাছস্ ক্যা? তুই এখন বড় হইছস না। কালকের থেইক্যা তোর লাইগা পাঁচ টাকা কম কইরা রাখমু। প্রতি প্যাকেট চকলেটেই রাখমু। মাঝে মাঝে একা
একা আমার এইখানে সন্ধ্যায় চইলা আসবি। মজা পাইছস্ না। সত্যি কইরা ক তো?’
বড় বড় চোখ করে কলমি তাকিয়ে ছিল আদুলের পানে। কি বলছিল
সম্ভবত ঢুকছিল না ওর কানে। হাতদুটো বুকের কাছে চেপে ধরে কুঁকড়ে আছে। গায়ের ছেড়া জামাটার ছেড়া ফুটোটা এখন আরও বড়
হয়েছে। ফর্সা বুকের অনেকটাই এখন দেখা যাচ্ছে। ফর্সা গালে স্পষ্ট আঁচড়ের একটা দাগ
অনেকটাই স্পষ্ট হালকা আলো আঁধারেও। গাড় লাল হয়ে উঠছে ক্রমে। পায়জামাটা পাশে পড়ে
আছে বিষন্ন একাকী।
আদুল একটা কোকের বোতল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,‘নে, খা। আর তাড়াতাড়ি পায়জামাটা পইরা ল।’
ঠিক তখনই নাচতে নাচতে এসে হাজির হলো আলতা।
‘কিরে ওমন টাসকি মাইরা বইসা আছস কেন, কি হইছে তোর? ঐ আদুল
মিয়া ওরে মার...’
থমকে গেলো কথা আলতার। বুঝতে খুব একটা দেরী হলোনা অন্তত পড়ে
থাকা পায়জামাটা দেখে তো নয়ই। গতমাসে বস্তিতে লায়লা বু’র ধর্ষনের ঘটনা ওদের শিখিয়েছিলো বাস্তবতার তীব্রতা অনেক কাছ থেকে। বুঝে গেলো
আলতা তাই একটু আগের অদেখা অঘটন। তবুও জিজ্ঞেস করল, ‘ কিরে আদুল মিয়া কি করছো ওরে?’
হাউমাউ করে কেঁদে উঠল এবার কলমি। জড়িয়ে ধরল আলতার পা। আলতা
পায়জামাটা পড়িয়ে দিতে দিতে চিৎকার করে বলল, ‘আমি বস্তিতে বিচার দিমু’। যদিও সে জানে লায়লার বিচারে কোন লাভ
হয়নাই। উল্টা বস্তি ছাড়তে হয়েছে।
‘ওরে বাড়ী লইয়া যা। এই ল কালকের লাইগা চকলেট; টাকা পরে দিস।’
॥সাত॥
তরতাজা বয়স এবং বুক
ভরা সাহস ছিল ইসরাফিলের। আর ছিল গ্রামে এক টুকরো ভিটে । সেখানে নিকটজন বলতে
একমাত্র দাদীকে নিয়েই তার বসবাস ছিল। পেটের তাগিদে ঢাকায় চলে আসে। পুরোনো বন্ধুর
সাথে উঠে আসে বাঁধের ওপারের বস্তিতে। রিকশা চালাতে শুরু করে। বস্তিতে কিছু মাস্তান
বন্ধুদের সাথে সখ্যতা আর গরম রক্তের কারনে একটা দাপট ও তৈরী হয় তার। সেই দাপটের
সাহসে পুরানো প্রেম মনে হাহুতাশ এর বাতায়ন জোরে প্রবাহিত করতেই একদিন হঠাৎ গ্রামে
ফিরে প্রেমিক লায়লাকে সবার সামনে দিয়ে হাত ধরে ঢাকায় নিয়ে এল। বস্তিতে উঠেই বিয়েটা
সেরে ফেলল। সাথে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিল বুড়ো দাদীটাকেও।
গ্রাম্য সুন্দরী লায়লা। দূরন্ত যৌবনবতী। তার দেখভার দাদীর
উপর ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে টাকা কামানোর জন্য দুবেলা রিকশা চালানো শুরু করে ইসরাফিল।
সে স্বপ্ন দেখত একদিন অনেক টাকা হবে। একটা দোকান দেবে
বাজারে। বস্তিতে থাকতে হবে না আর। লায়লাকে বউ করার পর খুব ভয় হতে তার মত সাহসী
যুবকেরও। বস্তিতে তারই বন্ধুগুলোর চোখে সে লালসার আগুন জ্বলতে দেখেছে। কানেও আসত
নানান কথা। বউকে যখন তখন নানান কু প্রস্তাব শুনতে হয়। কোথাও কাজে পাঠাতেও ভয় পায়
সে। দাদী আছে বলেই অনন্ত এখনও রক্ষে। ও পরিবেশে সংসার হয় না। সে বুঝে ফেলেছিল।
বউয়ের সাথে প্রায় রাতেই আলাপ হত। গ্রামের ভিটে টা বিক্রি করে দেয়া পরিকল্পনাটাও
পাকাপাকি নিয়েছিল। একটা দোকানের খোঁজ ও পেয়ে গেলো। দোকানটা কামরাঙ্গির চরে। মুদির
দোকান। সারাদিন রিকশা চালায় আর রাতে সে ভবিষ্যতের স্বপ্নের জাল বোনে স্বামী স্ত্রী।
কিন্তু বিধি বাম। গরীবের কপাল আসলে গরীবের মতই। মালিবাগ
রেলক্রসিংয়ে এক ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনাটা ঘটে গেলো। নিরাপদে স্থানেই সরে ছিল
ইসরাফিল। ট্রেনটা প্রথমে ধাক্কা দিয়েছিল
প্রাইভেট একটা সাদা কারকে। সেই কার উড়ে এসে পড়ল আরেকটা কারের উপর। পাশে ইসরাফিল
কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ির তলায় পিষ্ট । ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হলো তার। বেশ কয়েকদিন
সে ঘটনার আদ্যপান্ত উদ্ধারের চেষ্টায় অনেক কিছু লিখে সাংবাদিকরা তাদের কর্তব্য
কর্ম পালন করা মহা সুযোগ পেয়ে গেলো। এক লাইনে প্রথম দিন অজ্ঞাত এক রিকশাওয়ালার
মৃত্যুর খবরপটাও এসেছিল।
ঘরে না ফেরায় একদিন অপেক্ষা করেছিল। তারপর লায়লা ইসরাফিলের
দুজন বন্ধু কে নিয়ে হাসপাতাল খুঁজে বিকৃত লাশ দেখে চিনেছিল ঠিকই। সাংবাদিকরা ওমন
চরম একটা নিউজ আর জানার সুযোগ পায়নি। পেলে রিকশাওয়ালার লাশ উদ্ধার নিয়ে একা কলাম
ঠিকই ভরিয়ে ফেলত । নাম উদ্ধার হয় নি।
সরকার কর্তৃক সে রেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু জনিত সাহায্য দেয়ার খবরও লায়লার কানে
আসেনি । তার কানে তখন দুর্বিসহ কুমন্ত্রনা ঢালছে বস্তির নানান জন নানান রূপে।
নাতির মৃত্যুর খবরে হঠাৎ রাতে হার্টফেল করে মরে গেলো বুড়িটাও। কবর দেয়া হলো। তেমন একটা জমানো টাকা ছিল না লায়লার
কাছে। যা ছিল তাও দু দুটো লাশের সৎকার আর অন্যান্য খরচে প্রায় শেষ।
জমিটার খোঁজ খবর করতে চেয়েছিল। ততদিনে জমি নিয়ে
গ্রামে দখল বেদখল মারামারি অনেক কিছুই হয়ে
গেছে। একা লায়লার কিছু করার ছিল না। অগত্যা গার্মেন্টেসে কাজের চেষ্টা করলো। সেলাই
কাজটা একটা আধুটু গ্রামে থাকতেই জানা ছিল। সেটাই পুঁজি। কাজ ও পেয়ে যাবে যাবে ।
এরই মধ্যে একদিন সন্ধ্যায় ঘটনাটা ঘটেই গেলো। বুড়ি দাদী নেই। কে আর দেখে রাখে।
বস্তি প্রতিবেশী কার এত দায় পড়েছে। বরং স্বামী হারা একাকী লায়লা এখন বস্তির গলার
কাঁটা। আজেবাজে ছেলে ছোকড়া লাইন মারার চেষ্টা করছে রোজ।
কলমি আর আলতা রোজ সন্ধ্যায় আসত লায়লার ঘরে। মাঝে মাঝে তাদের
এই সুন্দরী আদুরে ভাবীটার জন্য ফুলের মালাও তারা দু’একটা নো বেচে নিয়ে আসত।
ঘটনার দিন সন্ধ্যাতেও তারা বস্তিতে ফিরে ছুটে গিয়েছিল
লায়লার ঘরে। ঘরের চারপাশ ঘিরে লোকজনের উৎসুক দৃষ্টি ঘরের মধ্যে কি যেন খুঁজে
বেড়াচ্ছে। সে যে কি জিনিস তা ব্যক্তি মাত্রই জানে। অন্যজনে মোটেও না।
বিছানায় ছোপ ছোপ রক্ত। লায়লা কাঁদছিল। কেউ এগিয়ে আসছিল না।
সবাই জানত এটা কাদের কাজ। তারা তার দেহটাকে পুঁজি করে টাকা বানাতে চেয়েছিল। লায়লা
রাজী হচ্ছিল না কিছুতেই। সেই দেহটার সতিত্বের গর্ব ধূলিস্মাৎ করে দিয়ে গেছে এক
বিকেলের ধূসর নির্জনতায়।
আলতা আর কলমি ধরে উঠিয়ে বসিয়ে দিয়েছিল। জিজ্ঞাস করছিল ‘ কি হয়েছে
বু,কেডায় মাইরছে তোমারে,কেডায়?’
‘মাইর নারে কলমি,এ মাইর না...এই শরীলে এক মধুর চাক আছে না আমগো, হেইড্যা খাওনের লাইগ্যা পোকা
আইছিল, পোকা, আরও আইবো, আরো...
‘আমগো শরীলেও আছে বু...?’
পাগলীনির মত হাসছিল লায়লা। বুঝিয়ে ছিল দুই কিশোরীকে যতটা
বোঝানো যায়। তারপর বলেছিল,
‘পুরুষগুলা সব হায়নাদল,
সুযোগ খোঁজেরে কেবল সুযোগ খোঁজে। সাবধানে থাকিস।’
হাতমুখটা ধুয়েই ছুটেছিল লায়লা । দেরী করলে সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে যাবে। মঈদুলের অফার টা সে মনের জঞ্জাল
হাতেড়ে বের করে আনল। ছুটল সেদিকেই। সেই যে গেলো আর ফেরেনি বস্তিতে কোনদিন। তবে
দুদিন দেখা হয়েছিল আলতা আর কলমির সাথে। সে ঐ রাজপথেই।
লায়লার কথা ভেবেই তাই কলমির জীবনে কি চরম বিপর্যয় ঘটে গেছে
সে বিষয় অনুধাবন করেত পারে আলতা। চিৎকার করে ওঠে। পার্কের আঁধারের ব্যাপারি কয়েকজন
আলতার চিৎকারে ছুটে এল এদিকে। ততক্ষণে আদুলেরও দোকন বন্ধ করা হয়ে গেছে। লোকজনের
আওয়াজ পেয়েই সে চম্পট দিল। অসহায় দুটো মেয়ে একা পড়ে রইল। ছুটে আসা গুটিকয়েক
লোকের মধ্যে রত্নাবুও ছিল। এরাই তো আসবে। এই অন্ধকারে পার্কে তথাকথিত ভদ্র মানুষেরা তো আর
থাকার কথা নয়। রত্নাবু অভিজ্ঞ নিশিকন্যা। যা বোঝার সবই সে বুঝল ঠিক। বলল,‘কোন হালার পুত করছেরে এই কাম?’
আলতা আদুল মিয়ার নামটা নিল প্রচন্ড বিতৃষ্ণা ভরা কন্ঠে।
তারপর রত্না আর আলতা মিলে কোনরকমে কলমিকে ধরে
পার্কের বাইরে নিয়ে এল। নিশিকন্যাদের সাথে অনেক রিকশাওয়ালারই খাতির থাকে।
ব্যবসায়িক একটা প্রয়োজনেই সেটা হয়ে ওঠে। পরিচিত একটা রিকশাওয়ালাকে ডেকে ওদের
দুইজনকে রিকশায় উঠায় দিয়ে এলো। ভাড়াটাও দিয়ে দিলো।
‘আলতা আমিও যাইতাম। কিন্তু একটা কাষ্টমার কল দিছে,যাইতে
হইবো রে? ওরে নিয়া ডাক্তার দেখাইস। সকালে আমি খোঁজ নিবানে? যা।’
বসে থাকাতে ওতোটা বুঝতে পারছিলনা। রিকশা থেকে নেমে বস্তির
মধ্যে ঢুকার সময় বুঝল ব্যাথাটা। হাঁটতে
বেশ কষ্ট হচ্ছে। আলতার কাঁধে ভর করে ঘর পর্যন্ত যেতে হলো কলমিকে।
॥ আট ॥
কলমির সৎ মা একটু আগেই বাসা বাড়ীর কাম শেষ করে ফিরেছে। ঘরেই
শুয়ে ছিল। কলমির ফর্সা মুখে স্পষ্ট নখের আঁচড়ই যথেষ্ট ছিল তার বোঝার জন্য। বয়সের
ভার বোঝে কোন আঁচড় কেমন হয়। তবু জিজ্ঞেস করল,‘আলতা কি হইছে রে?’
বৃত্তান্ত শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো কলমির সৎমা। কিন্তু
অভিজ্ঞ নারী ক্ষণিকেই বুঝে গেলেন চিৎকার চেঁচামেচিতে সমস্যা
বাড়বে বই কমবেনা। মুহূর্তে চুপসে গেলেন। ফোলা বেলুনের বাতাস যেন বের হয়ে গেলা।
কলমির বাপ বাড়ীতে ছিলনা তখন। আলতা পাশে বসে তখনও কাঁদছে আর কলমির মাথায় হাত বুলিয়ে
দিচ্ছে।
এর মধ্যে একবার নিজের ছোট পোলাটারে পাঠাইছিল সৎ মা আদুলের
ঘরে। খবর নিয়ে এল। এখনও ফেরে নাই আদুল।
অনেকটা সময় পার হল ধীরে ধীরে। ডাক্তার ডাকা হলো না। গরীবের
ডাক্তার তো ভাগ্যই চিরকাল!
রাত ১০টার দিকে আদুল নিজেই এলো। কলমির মার সাথে দেখা করলো।
আলতাও কলমিরে একটু ঘুম পাড়িয়েততক্ষণে ঘরে চলে গেছে ।
মেজাজটা প্রথমে চড়াই ছিল মহিলার,‘এতটুকুন মাইয়ারে... তোর লজ্জা করলনা একটুও। বিয়া করবি ওরে? ওর কি
হইব? ওর বাপেরে আমি কি কমু ? তোর বিচার করমু কাইল দেহিস। তোর
খবর আছে। মাইনসে পরে কইবো সৎ মা দেইখ্যা মাইয়াডার কোন ন্যায্য বিচার দিইনাইক্যা।
তুই হারাম...’
আদুল কলমির সৎ মার সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানে। জানত
ওই নারীর লোভ লালসা আর স্বভাব সম্পর্কেও।
তার উপর স্বামীটা পার মাতাল। কাম কাজ কিছুই করেনা। তারে টাকার
লোভ দেখাইলে সব সম্ভব। দিদি দিদি সম্পর্ক তার উপর ও মহিলার সাথে। আদুলই বস্তিতে
একমাত্র জানে এই মহিলার অতীত। কলমির বাপকে বিয়ের আগে এই মহিলারে সে রমনাপার্কে রত্নাদের মত অবস্থায় কত দেখেছে। এ দিদি তো তার সেই দিদি সম্পর্কেরই বর্তমান
রূপ। একশটাকা বার করে হাতে দিয়ে বলল, ‘দূর ! চিল্লাও কেনো?
তুমিও পাগল হইল্যা নাকি? ওষুধ পত্তর লাগলে ব্যবস্থা কর
দিদি। আর বাচ্চা মাইয়া কও কেন। হে তো বহুত শক্ত সমর্থ। দেখছ কিছুই হয়নাই। তোমারে
একটা ভাল বুদ্ধি দেই। মঈদুল ভাইয়ের কাছে ওরে পাঠায় দেও। মঈদুল ভাই তো তোমারে কত
কইছে ওরে হোটেলে পাঠাইতে। রাজী তো হওনা। ’
‘আমি তো ভাবছিলাম আরেকটু বড় হইলে মঈদুলরে আমি নিজেই কমু। এই বয়সে ওতো ঠেলা সইতে
পারব নাকি? আমি তো বুঝি?
সেই ক ছোট্ট থাকতে .. সে যাক, এখন ওর বাপেরে কি দিয়া বুঝ দিমু ?’
‘হেরে কি বুঝাইবা...। দু এক ঘন্টা চিল্লাইবো। টাকা দিলেই দেখবা সব ঠিক। মাতাল
মানুষ। মদ কেনার টাকা পাইলে আর কিছু লাগে নাকি। চিন্তা কইরা দেখ। এমনতেই ওর মত
সুন্দরীরে তুমি কয়দিন সবার হাত থেইকা বাঁচাইয়া রাখতে পারবা। ওই বয়সি মাইয়াগোই বেশী
ডিমান্ড হোটেলে আইজকাল। আমি মঈদুল ভাইরে কইছি আইতে। আইবো কইছে। একটু ভাব। আমি
চললাম। ভালো টাকা দিবনে তোমারে এককালীন, কইছে। মঈদুল ভাইয়ে লইয়্যা আমুনে
আবার।’
মঈদুল এক হোটেলে দালালি করে। পতিতার দালাল। আগে এ বস্তিতেই
থাকত। এখন আর সে বস্তির নিম্ন শ্রেণীর মানুষ নয় মোটেও। অন্য নিম্নতায় নিমজ্জিত
থেকেও সমাজে বস্তি ছেড়ে যথেষ্ট উঁচুতে উঠে গেছে আজ।
আধঘন্টা পরে সেই মঈদুল কে সাথে করে ফিরে এল আদুল মিয়া।
মঈদুল বোঝানোর কাজে এক্সপার্ট। ‘আরে বইন, লায়লা এখন আমার ওইহানে কাম করে। জান হেই কি সুখে আছে। বাড্ডায় এক ভাবীর বাড়ীতে
থাকে। হেই বাসাতেই বইসাও হের বহুত ইনকাম। আর দুইদিন সপ্তায় তো আমার হোটেলেও আহে।
হেরে দেখলে এখন চিনতেই পারবানা। কও , এইডারে কয় শাপে বর। ’
আরও অনেক কিছু
বুঝাইল মঈদুল। সৎ মার অনেকটাই বোঝা ছিলা আগে। বাকীটা বোঝার জন্যই সে মুখিয়ে ছিল।
সৎ মার সে বোঝাই কঠিন বোঝার মত চেপে ধরল অসুস্থ কলমির ঘাড়।
না করার কোন অপশনই সেখানে ছিলনা। মার তীব্র চাপাচাপিতে পরদিন কলমি বাধ্য হয়েছিল
মঈদুলের সাথে যেতে। হোটেলের আড়ালে অপ্রকাশ্য প্রকাশ্য গণিকালয়ে নিয়ে গেলো মঈদুল
তাকে। কান্নাকাটি থামানোর জন্য মঈদুল ওকে ভয় দেখাল- না গেলে সবাইকে বলে দেবে
...বলে দেবে, পার্কে যেয়ে সে অপকর্ম করে বেড়ায়। বাপের কানে তুলবে ওসব কথা। কলমি কি করব
বুঝতে পারেনা। বুঝতে পারেনা ওই ঘটনায় ওর কি দোষ। মাকে তো ভয় পেত আগে থেকেই ভীষণ।
উপায় ছিলনা। মঈদুলের সাথে যেতেই হলো। আসলে এত অল্প বয়স। তার উপর গত সন্ধ্যার এই
অজ্ঞাত যন্ত্রনার যাতনা আর বিতত মন। সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন ক্ষমতাই কি আর তার আছে?
কলমির বাপ ব্যাপারটা জানল দুদিন পরে। বউরে পারলে মারে আরকি।
কিন্তু সে ঐ সাময়িক। বউয়ের দেয়া মদের প্রাচুর্যে সব ভুলে কাটিয়ে দিল দুদিন। আর তারপর তৃতীয় দিন থেকে
মেয়ের শরীর বেঁচা টাকা মদ কেনার অফুরন্ত টাকা হয়ে যখন নিয়মিত হাতে আসতে লাগল কোথায়
উড়ে গেল তার সে রাগ,
বিরাগ আর চিৎকার।
॥ নয় ॥
এক বছর পরের কথা...
আলতার মা ইদানিং বেশ অসুস্থ থাকে। ঘরে পড়ে আছে । অনেকদিন
হলো কাজে যেতে পারেনা। সেই ওষুধে আর ভাল হচ্ছেনা পেটের ব্যাথা। এক ওষুধে আর কত
বছর! ও ওষুধও চিনে ফেলেছে রোগ।
আলতা এখনও পথকন্যা হয়ে শাহবাগের মোড়েই টিকে আছে। একা একাই
শাহবাগের মোড়ে ফুল আর চকলেট বিক্রি করে। যে টাকা আয় হয় তাতে মা আর
নিজের মুখে দুবেলাও ঠিক মতো ভাতই জোটেনা।
মায়ের চিকিৎসা ভাবনাই তো মনে ঠাঁই পায়না। ওদিকে সেই কর্মঠ ভালবাসার পাত্রটি তার সেও দারিদ্রতা হতে মুক্তির ধীর
স্থির আর সুদীর্ঘ কালের অপেক্ষা সহ্য করতে পারছিল না। গায়ে এক শক্তি অথচ পকেট
ফাঁকা। গায়ের শক্তির চেয়ে চেয়ে যে পুরুষ মানুষের মাথার ভেতরের শক্তি বেশী প্রয়োজন
সে সত্য তাকে কেই বা শেখাবে? শেষ পর্যন্ত দুলাল
হোটেলের ক্যাশ থেকে টাকা চুরি করেই ফেলল একদিন। আদুলের দোকানের কাজটা তারও আগেই
ছেড়েছিল। লোভ পেয়েছিল লোভ। কলমির কথা ভুলতে সময় লাগেনি। টাকার কথা শুরু হয়েছিল
তাই। এখন জেলের ঘানি টানছে। ছুৃটে যাবে
যখন তখন , তারপর হয় চরম অবনতি কিংবা উন্নতি!
ভীষণ নিঃসঙ্গ আজকাল আলতা। মনের কথা বলার মত কেউ
পাশে নেই আজ তার। কলমির সাথে খুব একটা দেখা হয়না। সময় কই কলমির। কলমি আগের চেয়েও
অনেক সুন্দর হয়েছে। মাথায় হয়েছে লম্বা
চুল। রঙিন রঙিন শাড়ি, কামিজ ... পরিপাটি ইস্ত্রী করা সবসময়। অনেক ডিমান্ড আজ ওর।
মঈদুল সব সময়েই ওর সাথে। সোনার ডিম পাড়া হাসরে তো আগলে রাখবেই।
মাঝে মধ্যে আলতার সাথে কলমির দেখা হলেও তেমন একা কথা হয়না। কেমন জানি পর পর লাগে।
অথচ কলমিকে ছাড়া আর কাউকে কখনও বন্ধুই ভাবতে পারে
না সে। একা একা তো সে কারনেই। দেখা হলে দু’জনার
মধ্যে কথাও হয় যৎ সামান্য। ‘কেমন আছস, কি অবস্থা...’ এই
দুএকটা ভাল মন্দ জিজ্ঞাসা হয় বড়জোড়। এর বেশী কিছু না। পরশু আলতার মাকে দেখতে
এসেছিল কলমি। ওর পরনে ছিল লাল টুকটুকে একটা কামিজ, কালো ওড়না আর কালো সেলোয়ার।
পরিষ্কার। ইস্ত্রী করা। ঠোঁটে টুকটুকে লিপিস্টিক। গায়ে সেন্ট আর পাউডারের মিশলে
কড়া গন্ধ। বেশ কিছু টাকা দিয়েগিয়েছিল আলতার হাতে। আলতা হাত পেতে নিতে নিতে মনে
করছিল দশ টাকা নিয়ে দুজনার সেই চুলাচুলি। চোখে পানি এসে গিয়েছিল।
আজ সকালে মা বেটি দুজনের পেটের জ্বালা মেটানোর মত কোন খাবার
ছিলনা ঘরে। কলমির দেয়া টাকাও শেষ ওষুধ কিনতে গিয়েই। অসুস্থ মা ক্ষ্যাপলো ভীষণ।
‘ওই কালী ঢুমসি?
পারসনা ওই কলমির লাহান নাগর ধইরা টাকা কামাইতে। দেখস্না হের
কি সুখ। পেট পুইরা তিন বেলায় খায়। ভাল কাপড় পিন্দে। পারসনা কেন। না পারলে আমারে
গলা টিইপা মার। তুইও মর। ...’
ঘর থেকে ছুটে বের হয়েছিল সে। কলমিকে পেয়ে গেলো কপাল গুনে। ওর
টাকা ধার করে এনে দুপুরে মাকে খাওয়ালো। টাকা দেওয়ার সময় কলমি বলছিল, ‘তুই অনেক ভালো আছস রে। তোর লাইগা তোর মা আছে । তোর মার লাইগা তুই। আমার লাইগা
কেউ নাইরে। কেউ না। ’
আলতা কোন উত্তর দিতে পারেনি। হাত পেতে টাকা নিয়েছিল। আলতা
বলতে চেয়েছিল, ‘ তোর
লাইগা আমি আছি রে,
আমি।’ বলতে পারেনি।
পরদিন বিকেলে আর
পারছিলনা আলতা। মার মরা মরা মুখ এর কষ্টের ছাপ সহ্য করার মত মনের বা দেহের জোড় আর
অবশিষ্ট নেই। বিকেল কলমিকে পথে দেখে বলেছিল, ‘তোর সাথে আমারে নিবি?’
কলমি মানা করেছিল।
হেসেছিল মুচকি। অবোধ্য মিষ্টি হাসি।
বাধ্য হয়ে শেষে গিয়েছিল মঈদুলের কাছেই। মঈদুল বলেছিল, ‘দেখি কি করন যায়। হোটেলে তো হক্কোলে ফর্সা মাইয়া খোঁজেরে , তুই তো
ভীষণ কালা। দেখি তবুও লায়লার ওইহানে কিছু একটা ব্যবস্থা করুম নে।’
উপায় ছিলনা। দেরী সইছিলনা। কলমি আর মঈদুল সেদিন রাজী না
হলেও রাজী করাতে পেরেছিল রত্নাবুকে। রত্না তাকে ঠিকই নিয়ে গিয়েছিল রাজপথের ভ্রাম্যমান গণিকালয়ে। নিশিকন্যার আসরে
নতুন একজন হয়ে ওঠার প্রচেষ্টায় সেও হলো সফল।
সে রাতে ফিরেছিল হাতে নগদ একশ টাকার দু দুটো নোট আর গায়ে কুৎসিত অদৃশ্য কতগুলো ছাপ নিয়ে। রাত ১২ টা বেজে
গেলো। মার জন্য অনেক ভাল খাবার ও নিয়েছিল। দেহবেচার প্রাথমিক প্রাকটিক্যাল পাঠটা
তার শেখা হয়ে গেল সেদিনই। যেমন শেখা হয়েছিল বছর খানেক আগে কলমির আদুলের পাশবিকতার
কোপানলে পড়ে থিউরেটিক্যাল অংশ।
মা তার ঠিকই
বুঝেছিল। খুব কাঁদছিল। মন না চাইলেও পেটের জ্বালায় খেতে হয়েছিল মেয়ের ইজ্জত বেঁচা
টাকায় আনা ভাত। পরদিন সকালেই আলতার মা মরে গেলেন।
গগন বিদারী চিৎকার দিয়েছিল আলতা। কেঁদেছিল অঝোরে। সম্ভবত সেই ছিল তার শেষ কান্না।
...কলমিকে রাজী করাতে পেরেছিল আলতা। কলমির চাপচাপিতে মঈদুলও মানা করেতে পারেনি।
ব্যবস্থা একটা করেই দিল। কলমি জানত রাজপথের চেয়ে ঢের ভাল তার কাজের জায়গা। দুই সখি
অনেকদিন পরে আবার একসাথে তাই নেমে গেল ব্যবসায় ।
রাজপথে অসম্ভব হারে জ্যাম বেড়েছে। সে জ্যামে থেমে থাকে এই
শহরের অতি সভ্য যান্ত্রিক মানুষগুলোর সময়, কর্মহীন-অকারন
ঘন্টার পর ঘন্টা। আলতা আর কলমীর ব্যবসা তখনও চলতেই থাকে কোন চার দেয়ালের আড়ালে।
এখন আর তারা ফুল বেঁচে না,ফুলের মালা নিজেরাই কেনে অচেনা কারও মনোরঞ্জনে।
[আমার প্রথম গল্প সংকলন ‘ঋতানৃত’ তে ২০০৬ সালে গল্পটি আরও সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এবং উপরের বর্ধিত কলবের রুমানা বৈশাখী, প্রিন্স আশরাফ এবং আমার সম্পাদনায়
প্রকাশিত আলো্ওছায়া সাহিত্য ম্যাগাজিনে ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন