পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০১৩

মোর‌্যাল সিনোপসিস!

মফস্বলের যে এলাকায় বড় হয়েছি সে পাড়াতেই এক পাড়াত ছোট ভাই ছিল, ভীষন অনুরক্ত ছিল আমার। দেখা মাত্রই, শ্যামল দা, শ্যামল দা বলে ভক্তির রসে বাতায়ন সিক্ত করে তুলত। মাঝে মাঝে তার অতি ভক্তি বিরক্তির উদ্রেগ করলেও তাকে যে আমি অপছন্দ করতাম না সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহাতিত। ছেলেটার মাঝে কিঞ্চিৎ বাউন্ডুলে ভাব ছিল এবং সামান্য লেখালেখিরও প্রচেষ্টা ছিল। আমি তাকে যথাসাধ্য জ্ঞান দান করতাম কারণ সে আমার কাছে তা প্রার্থনাও করত। তারপর আমি বহু কষ্টে মধ্যপ্রাচ্যে একখানা চাকুরী জুটিয়ে যখন পাড়ি দিলাম, বিদায়ের সময় তার  করুণ চেহারাটা  আমার কাছে অম্লান স্মৃতি হিসেবে রয়ে গিয়েছিল।
বৈদেশিক ব্যতিব্যস্ততায় প্রথম বছর তিনেক তার সাথে আমার কালে ভদ্রে কথা বলার সুযোগ হতো, তারপর একদিন আমিও যখন অনলাইন সোস্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যোগাযোগকে নিকটবর্তী করতে শুরু করলাম, সেও যেন হাতে চাঁদ পেলো। আমিও খুশি হলাম  এই ভেবে যে কয়েক বছরের ঢিলে সম্পর্কের পরেও আমার প্রতি সে আজও ভক্তির রস অকাতরে বিলাতে কুণ্ঠা বোধ করছে না। আমি সময় কম পাই,  ছোট ভাই পড়াশুনা করছিল জানতাম, তা শেষ করে ঠিক কাজ করছে সেটা তখনও জিজ্ঞেস করা হয় নি, মূলত সেই আমাকে সোস্যাল নেটওযার্কে রোজ রোজই কোন না কোন ম্যাসেজ পাঠায় আর আমি হ্যাঁ, না, কিংবা নিদেন পক্ষে-হুম ঠিকই বলেছো- এই ধরণের এনসার দিয়ে ছেড়ে দেই, আমার যে কাজ তাতে ওর চেয়ে বড় লাইন লেখার সময় খুব কমই হয়। ছোট ভাইয়ের ম্যাসেজ গুলো দেখলে আমার বাংলা কোন পত্রিকার হেডিং আর পড়তে হয় না, কারন তার ম্যাসেজগুলোর সারমর্ম প্রায় ঐ হেডিংয়ের মোর‌্যাল সিনোপসিস। যেমন বাংলাদেশের কোন পত্রিকারন হেডিংয়ে শেয়ার কেলেংকারির নিউজ চলছে, ছোট ভাই লিখবে -দাদা দেখেছেন, দেখেছেন এ দেশে কিচ্ছু হবে না, ব্যবসায়ীরা সব যে বদ কিংবা কোন গার্মেন্টেসে আগুন লেগেছে বা কোন দালান ধসে গেলো অমনি সেদিন লিখলো, দাদা শিল্পপতিরা একটাও মানুষের জাত না। কিংবা আবার কোন সরকারী আমলার দুর্নীতির খবর এসছে, অথবা কোন পুলিশের কোন অপকর্মের খবর-সে বলবে, দাদা দেখছেন সরকারী চাকুরীজীবিরা কি বদ, সব খারাপ। আবার কোনদিন কোন ব্রীজ ভেঙে পড়ল অথবা খবর ছাপা হলো অবৈধ কল টার্মিনেশনের- সে লিখলো, দাদা আসলে এই দেশের প্রকৌশলীগুরো একটাও ভালো না, সব খারাপ, তারপর আরেকদিন লিখল- দাদা দেখেছেন দেশের ডাক্তারগুলো সব কসাই, একটাও মানুষ না। কদিন পরেই, খবর আসে রাজনীতিবীদের কুকীর্তি, সে লেখে সাথে সাথে-দাদা এ দেশের রাজনীতিবীদরা সব কত্ত খারাপ দেখলেন, আরেকদিন --দাদা ছাত্র নেতাগুলো ও সব খারাপ, কি যে ভবিষ্যত দেশের...আরকেদিন পত্রিকায় খবর এল এক বিচারকের নামে , লিখল-দাদা, বিচারকও নষ্ট হয়ে গেছে, উকিলদেরও সম্পর্কে আরেকদিন তার একই কথা, সেদিন নিউজ ছিল বার কাউন্সিলে মারামারি সম্পর্কিত। আরেকদিন খবর এলা দেশের বৃদ্ধিজীবিদের নেতিবাচক এক বিষয়ে, সে লিখল দাদা- কি যে হবে, বুদ্ধিজীবিগুলোও সব নষ্ট হয়ে গেছে। এক মডেলের নষ্ট চরিত্রের রসালো উদঘাটন ঘটালো কোন খবরওমনি সে লিখলো-দাদা, আসলে ঐ মডেল আর অভিনেতরাও সব নষ্ট হয়ে গেছে। শেষে একদিন তো বলল, দাদা আর কি বলব, ধর্ম নিয়েও ব্যবাস শুরু করেছে হুজুররা, তারা যা উল্টোপাল্টা শুরু করেছে দাদা, তাররপর অন্যদিন -দাদা দেখেছেন লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালিয়ে মানুষ মারে, কত্ত খারাপ ড্রাইভারগুলোও..এমনি করে সে কেবল রোজ রোজ পত্রিকায় যখন নানান শ্রেণীর মানুষের নানান অপর্কীর্তির খবর আসে আর আমার কাছে উষ্মা প্রকাশ করে , সব নষ্ট হয়ে গেলো সব...এ দেশে কোন শ্রেণীই ভালো না। আমি একদিন বিরক্ত হলাম, আর কত ভালো লাগে, দেশে যে নেতিবাচকতার অভাব নেই, সে যে পুরো জাতির মাঝে তিলে তিলে ছড়িয়ে গেছে সে তো জানিই। কিন্তু দুটো পেশা শ্রেণীর মানুষকে সে কখনও খারাপ বলেছে এমন মনে পড়ে না। অথচ সেই দুই শ্রের্ণীও নেতিবাচ ঘটনার অভাব নেই। একদিন তাই জিজ্ঞেই করে ফেললাম, তুমি কি কাজ করছ আজকাল বলতো? জানালো, ও দাদা আপনাকে তো বলাই হয়নি, আমি মফস্বলে বেশ কয়েকটা জাতীয় দৈনিকের প্রতিনিধি, আমি সাংবাদিক। বললাম, ও তাই বুঝি সাংবাদিক আর প্রবাসীররাও যে ‘কত্ত খারাপ!’ এইটা আর বলো না কোনদিন। আসলে কি জান, আমরা বাংগালীরা তিলে তিলে এমন এক জাতিতে পরিণত হয়ে পড়েছি -আমরা নিজেদেরকেই চিনি না অথচ আশেপাশের সব মানুষকে চিনে ফেলি মুহূর্তে।

২৫/৭/২০১৩

1 টি মন্তব্য: