পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

প্রাণের বইমেলা, সাহিত্য ও প্রকাশনা-আমি এবং আমার অতীত বর্তমান

//মামুন ম. আজিজ
তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবেই এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে বহিঃবিশ্ব এবং আপন পরিধির ভেতরেও চিহ্ণিত করা হয়, অর্থাৎ আমাদের দেশটির পেছনে হয়তো কোন কোন দেশ আছে তবে সামনেও আছে ভরি ভরি দেশ। এ কথাটুকু আমার এই লেখার জন্য খুব প্রয়োজনীয় না হলেও এ কথাই শুরুতে না বলে পারলাম না এই কারণে যে আমাদের সামনে যারা মানে যেসকল দেশ রয়েছে, যারা জ্ঞান বিজ্ঞান, উন্নয়ন এবং বৈভবে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে তারাও এই আধুনিক উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বেও কাগজে ছাপা অক্ষরে লেখা এবং অতপর বাঁধাই করা যে জ্ঞান, ইতিহাস, তথ্য এবং কলা ও সংস্কৃতির ধারণ, বাহন, সংরক্ষন এবং পাঠের উপযোগী একটি চর্চা রয়েছে যাকে এক কথায় প্রকাশনা শিল্প বলা যায় তা বিন্দু মাত্রও বিস্মৃত হয়নি এবং তার যথাযথ প্রকাশ, রক্ষণ এবং পাঠের পূর্ব ধারাবাহিকতাকে এই ডিজিটাল যুগেও এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তারা উন্নত জাতি। আমাদের পাশের দেশ ভারতেও এই পুস্তক প্রকাশ এবং তা পাঠের রীতি এখনও মানুষ বিস্তৃত হয়নি। অথচ আমাদের দেশে এই পুস্তক প্রকাশ এবং পাঠ দুটোই রূপ বদলেছে এবং বদলানোটা খুব একটা ইতিবাচক যে নয় মোটেও তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না, ও সবাই জানে।

একাডেমিক প্রকাশনার বাইরের যে প্রকাশনা তা যখন থেকে বইমেলা কেন্দ্রিক হযে পড়তে শুরু করেছিল সে সময়টা আমার কৈশোরকাল, আমার আর আমার বড় বোনের একটা পাঠাগার ছিল, বিদ্যালয়ে পড়য়া দুই ভাইবোনের জন্যে সেই সময় হাজার খানেক বই নিয়ে গড়া সেই পাঠাগার ( নাম ছিল কিশোর সাথী গ্রন্থাগার) খুব ছোট কিন্তু বলা যাবে না। আমরা একটু ব্যবসায়িক চিন্তা নিয়ে পাঠাগারটি করেছিলাম। আমরা থাকতাম ব্যাংক কলোনীতে। আবদ্ধ পরিবেশ। আমাদের বই ভাড়া দেয়ার কার্যক্রম ভালোই চলেছিল (গোটা বিশেক বই অফেরৎ আসাটাকে তুচ্ছ ধরলে)। এক টাকা  বা দু টাকা করে বই ভাড়া দিতাম। আমাদের কালেকশনে সেবা প্রকাশনীর সেই সময় চালু সিরিজ প্রায় সবই ছিল। সেগুলো ভালোই ভাড়া যেত। মাসে যা আয় হতো তা নিয়ে তিন/চার মাস পর একবার আমি আর আমার বোন বাংলাবাজার পুরান বইয়ের দোকানে গিয়ে থলে ভরে বই কিনে নিয়ে আসতাম। সংখ্যায় সেটা কম ছিল না,  প্রতিবারই ৪০ /৫০ টা বা তার বেশি বই কেনা হতো। আর পাঠাগারে মোটা মোটা দামী এবং তথাকথিত উচ্চ মানের বইগুলো পেতাম বাবার কাছ থেকে। তো বুঝতেই পারছেন, এই বই প্রীতির পুরো উৎসাহ উদ্দীপনার ভাগিদার আমার প্রয়াত বাবা। কিশোর সাথী গ্রন্থাগার শুরু করেছিলাম যতদূর মনে পড়ে ১৯৮৯ সালে, আমি তখন ক্লাশ ফাইভে পড়ি আর আপু পড়ে এইটে । অবশ্য বই ভাড়া দেয়া শুরু করেছিলাম সম্ভবত ১৯৯০ সাল থেকে। বেশ কয়েকবছর , অন্তত আপু এইচএসসি পড়া পর্যন্ত মনে হয় চলেছিলো আমাদের এই কার্যক্রম।
স্মৃতিতে ফিরে গিয়ে একটু নষ্টালজিক হয়ে পড়লাম নাকি? সে যাক, যা বলছিলাম, বই মেলা কেন্দ্রিক প্রকাশনা শিল্প আমার কিশোর বেলায় পাকা পোক্ত হয়ে ওঠেনি। তখন সারা বছর জুড়েই বই পুস্তক প্রকাশ হতো। ইত্তেফাক পত্রিকার পাতায় এ্যাড দেখতাম। হুমায়ূন আহমেদের বই হলেই তো কিনে ফেলতাম। সেবার বইয়ের প্রতিটির নামে এ্যাড আসত ইত্তেফাকে, তিন গোয়েন্দা আর মাসুদ  রানা সিরিজের কোনটা মিস যেত না, সম্ভবত ক্ল্যাসিক সিরিজের বইও মিস যেত না। ইমদাদুল হক মিলনের কিছু বইয়ের নাম দেখতাম, কেনো জানি খুব একটা কেনা হতো না, কিনতাম তবে একুশের বইমেলা থেকে। তাহলে সেই কিশোর বেলা থেকেই বইমেলার সাথে আমার প্রেম। আগে বাবার হাত ধরে যেতাম, এসএসসির পর লায়েক হলাম, দাঁড়ি মোচ গজিয়েছে, বাবার হাত ধরে  আর কেনো, নিজেই যাওয়া যায়, বন্ধুদের সাথেই ঘুরতে মজা। সে সময় আবার দু এক লাইন কবিতার মত কিছু লিখি, লিখে লিখে ডায়েরীর পাতা ভরাই । বইমেলায় ষ্টলে থরে থরে বই দেখতে দেখতে মনের কোণে লোভ সঞ্চিত হতে থাকে , একদিন আমার লেখা একখানা বই, কোন এক ষ্টলে যদি দেখতাম, কেনো দেখিনা, কবে দেখবো...স্বপ্ন সেইরূপ গোপনে ধারণ করেই ফেলি। সেই সময়টাতে বইকেন্দ্রিক প্রকাশনা জগতের রোপনকৃত বীজ থেকে চারা গজিয়ে তা বড়ও হয়ে উঠেছে। সারা বছরের প্রকাশনা প্রায় আম জনতার চোখের আড়াল হতে শুরু করেছে। অথচ যারা এদেশে আজও নিজেদের সাহিত্যের ধারক বাহক হিসেবে একটা নাক উঁচু ভাব ধরে রেখেছেন তারাও প্রায় অধিকাংশই সে সমযটাতেও ছিলেন (আজকের জেনারেশনের খুব একটা নজরে পড়ার মত কেউ সেই পরিমন্ডলে প্রবেশ মনে হয় করতে পারেনি), তারা নির্দ্বিধায় এই সংকুচিত কেন্দ্রকে ফুটে উঠতে মানে এক বইমেলা কেন্দ্রিক প্রকাশনা ও সাহিত্য জগতকে গজিয়ে উঠতে দিলেন, কি বিস্ময়কর! কি ভয়ানক।
কিন্তু আমি বা আমার মত অনেক তরুণ, এই প্রজন্মের সাহিত্য প্রেমিক কিংবা দু কলম ( দু কীবোর্ড বললেও ভুল হবে না) লেখার অভ্যাস যার, তারা বইমেলাকেই ধারণ করে নিলাম, বইমেলা আসবে ঘুরে ঘুরে এগারো মাস পর, সেখানে একটা বই অন্তত যার উপরে সুন্দর মলাট এবং মলাটে নিজের নাম...এই স্বপ্ন মনে গেঁথে নিলাম। অথচ দুলাইন লিখতে শিখলেও প্রকাশনার কি উপায়, রীতি নীতি, পদ্ধতি তখনও জানি না। পরিমন্ডলটা একটু ভিন্ন , প্রকাশনা জগতের কাউকে তেমন চিনিও না, পড়তে চলে গেছি সেই দূরে আইইউটির ক্যাম্পাসে, সেখানে আলাদা জগত, আলাদা ভালো লাগা , আলাদা এক চর্চা-শ্রম। কিন্তু কবিতারাও যে বেড়েই চলেছিল।
তারপর একটা সময় বেড়ে চললো জীবন বোধ, বাস্তবতার প্রেষণ, একটা ভালো চাকুরী  বেশ সোনার হরিণ এত পড়া লেখা এত ভালো ফলাফলের পড়েও। তারপর হঠাৎ কি মনে করে বিসিএস দিয়েই ঢুকে যাওয়ার ঘটনা সরকারী চাকুরীতে। ছা পোষা জীবনে প্রবেশ তবুও একটু থিতুতো বটেই, এইবার সেই স্বপ্নের হাতছানি ডাকছে, যেন মাশ লর নীড থিউরীর পিরামিড, বইমেলা ঘুরতে গেলে কষ্ট হয়, কই কত বছর পেরিয়ে গেলো, আমার নাম, আমার বই কই! দু একটা ক্ষুদ্র পত্রিকায় দু একটা ফিচার, দু একটা কবিতা, কে দেখেছে, কে রেখেছে মনে, নিজেই মনে রাখা যায় না। তার মানে অন্যের মনেও প্রবেশ করতে হবে। একটা বই থাকতে হবে। উঠে পড়ে লাগলাম। পকেটে কিছু টাকা জমেছে, সংসার দেখা লাগে না। মনে হলো টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করাব, কিন্তু না হলে কে ছাপবে, কেনো ছাপবে কেউ, প্রকাশকের কি লাভ, আর আমার স্বপ্ন, কবিতাগুলো সব ডায়েরীতে পড়ে কাঁদবে, হারিয়ে যাবে একদিন। দূর! বের করেই ফেলি, শখের উপর কি আছে!
একে ওকে ধরে বাংলাবাজার দু এক প্রকাশনীতে ঢু মারলাম। ঘুরতে ঘুরতে দরদামে এক প্রকাশনীর সাথে সাধ্য আর সাধ মিলে গেলো। ২০০৬ সালের একুশে গ্রন্থমেলায় আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশ হলো কিংবা আমার বলতে দ্বিধা নেই প্রকাশ করালাম।
প্রবেশ করলাম প্রকাশনা জগতে।  এইবার চোখে আসল বইমেলা কেন্দ্রিক প্রকাশনা জগতের বানিজ্য রূপ। একেতো কেবল বইমেলা কেন্দ্রিক এক সাহিত্য জগত তার উপর লেখক কূলের বিপুল অংশের স্ব অর্থ লগ্নির চিত্র এবং প্রকাশকগণের অর্থ চাহিাদার উচ্চ মাত্রার এক হতে অপর ক্রম বৃদ্ধি চিত্র  দেখলাম। অভিজ্ঞতায় সিদ্ধ হলাম। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের লোভ আর লালসা হতে পিছুপা হতে পারলাম না।
এর মধ্যে ব্লগ আর ফেসবুক জীবনকে অনেক সহজ করেছে। আপন সাহিত্য অন্যকে সহজে দেখানোর সহজ উপায় পাওয়া গেলো। অথচ ২০০৭, ২০০৯, ২০১০, ২০১২, ২০১৩ সালেও বই প্রকাশ করালাম । অথচ সেই ফেসবুক আর ব্লগে লেখনী কৌশলের পরিচয় ঘটিয়েও প্রকাশিত বইয়ের বিক্রি বাটা বাড়ানো গেলো না। তারমানে স্পষ্ট বুঝলাম আমার সাহিত্য পরিচিত পরিমন্ডলের প্রাণে তেমন প্রতিফলন ফেলতে সক্ষম হয়নি। তারমানে ঐ সেই আসলে হয়তো এখনও অন্যের মনে ঢোকার মত লেখা লিখতে শিখিনি। এটাই আসলে সত্য!
তবুও প্রাণের বই মেলা, বাংলাদেশের সাহিত্য প্রকাশনার এক মাত্র কেন্দ্র যে মেলা সেখানে ষ্টলে একটি রঙিন বই, নিজের নাম ...সে লোভ পিছু ছাড়ে না। লোভটার মৃত্যুর ঘটেনা, ঘটবে কেমনে- সারা বছর ধরে অনলাইনে, লিটল ম্যাগে, এখানে সেখানে কত লেখা, লোভটার মৃত্যু ঘটলে অবশ্য কবর দিতাম কোন কদম তলে, কদম আমার প্রিয় ফুল।
২০১২ আর ২০১৩ তে আবার নিজেদের লেখক সংগঠন সংকাশ এর গল্প সংকলণ রচনায় জড়িত হলাম। বলে রাখা দরকার এই আরেক নতুন উপায় মাথায় এসেছে নতুন প্রজন্মের, একা একক বই প্রকাশের অনেক হ্যাপা, অনেকে মিলে একখানা সংকলন, একটা গল্পতো থাকছে কিংবা একটা কবিতা অন্তত। প্রকাশকও একটু কম খরচে রাজী হন। অনেকের লেখা, সবার কিছু গুণগ্রাহী থাকেই, বিক্রি তাহলে কিছু হবেই।
২০১২ তে সংকাশ এর প্রথম সংকলন নৈঃশব্দ্যের শব্দযাত্রা সম্পাদনায় আরও দুজনের সাথে নিজে জড়িত থাকলাম। বেশ কষ্ট হলো কিন্তু একটা সুন্দর সংকলন, সংগঠনের প্রায় ২১ জনের লেখা। সবাই মিলে কিছু প্রচার প্রচারণা করায় কিছু বিক্রি হলো। যদিও তা প্রকাশককে সেই মাত্রায় সন্তুষ্ট করতে পারলো না, তবে ২০১৩ তিনি আবার প্রকাশ করতে র্জাী হলেন। এবার আমি একা সম্পাদক। প্রকাশকগণের অনেকেই মেলার শুরুতে মানে ১ তারিখে বই প্রকাশ করলে যে কয়েক কপি বেশি বিক্রি করতে পারেন, সেটা হয়তো মানেন না, অবশ্য মানলেও উপায় নেই, প্রেসের শিডিউলে আমাদের নতুনদের বই সেই দেরীতেই মুখ দেখে মেলার। অনেক ক্রেতা বই সেই প্রকাশের মুখ দেখার পরে হয়তো আর মেলায় আসবেনও না।  দ্বিতীয় সংকলন নৈঃশব্দ্যের উচ্চারণ মেলায় এলো দেরীতে। ইতিমধ্যে সংকাশ সংগঠনে কিছু টানাপোড়ন শুরু হয়েছে। আমরা সবাই বাঙালিতো , এ নতুন কিছু নয়। কেমন যেন উৎসাহ খুঁজে পেলাম না সংগঠনের সদস্যগণের মধ্যেই। তারউপর বইমেলাই দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর গণজাগরণ মঞ্চের কারণে প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থা। মেলা শেষে বুঝলাম প্রকাশক এই সংকলন নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট নয়। ব্যক্তিগত আফসোস হলো সংকাশ সংগঠনেই সে  সময় নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষাকারী সদস্যের সংখ্যাই চল্লিশের কাছাকাছি। এরাও সবাই যদি প্রচার চালাতেন, নিজেরা উদ্যেগী হয়ে বইটি বিক্রি করার ব্যবস্থা করে প্রকাশকের মনঃতুষ্টি অর্জন করতেন তবে প্রকাশক নিজেই হয়তো পড়ের বছর ডেকে আবার সংকলন করতে আগ্রহী হতেন। যাক সে অভিজ্ঞতাও ভালো হলো না।
আজ থেকে তিরিশ/একত্রিশ বছর আগে একুশে গ্রন্থমেলা ছিল না। তখন কিন্তু বই প্রকাশ হতো। তখন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মত লেখক বাংলাদেশে লিখতেন, আরও আগে যাই, স্বাধীনতার পূর্বে তখনও বাংলা সাহিত্য চর্চা চলছিল, অনেক ভালো ভালো প্রকাশনা হয়েছিল। অবশ্য একটা যুদ্ধ বিগ্রহের পরিবেশ, আন্দোলনের পরিবেশে শিল্প সংস্কৃতি সাহিত্য এক অন্য মাত্র পায়, কিন্তু সে অন্য কথা, প্রকাশনাতো বইমেলা কেন্দ্রিক কিছু ছিল না। প্রকাশনা ছিলো লেখকের লেখা এবং পাঠকের পাঠের উপর নির্ভরশীল। একটা সুন্দর প্রকাশনা জগত গড়ে উঠছিলো। স্বাধীনতার পরেও সেটা বজায় ছিলো। এগিয়ে চলছিল। বইমেলা সেটাকে প্রতিহত করেনি কিন্তু মোটেও, বরং বইমেলা প্রকাশনা জগতকে তরান্বিত করারই কথা। বইমেলা ঠিকই তার তরান্বিত করার কাজটি করেছে, কিন্তু প্রকাশনা জগতের সেই নিজস্ব এগিয়ে চলাটা রুদ্ধ করেছে সারা বছর জুড়ে প্রকাশের ব্যর্থতা, সেই সাথে দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য চর্চার পৃষ্ঠপোষকার কিপটেমিও, তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, সারা বছর প্রকাশনার মধ্যে দৈনিক পত্রিকার নিয়মিত সুন্দর, প্রণিধাণযোগ্য, সর্ব লেখকের যথাযথ লেখার জন্য উন্মুক্ত সাহিত্য পাতার প্রকাশকেও আমি রাখব। সিস্টেমগুলো উঠে গেছে যেন। প্রকাশকগণেরও পান্ডুলিপি অন্বেষণের দূর্বলতাকেও দায়ী করা যেতে পারে অনেকটা। সর্বোপরি পাঠকের অভাব তো হয়েই গেছে নতুন প্রজন্মে। অনেকেই বলে পাঠের সময় কোথায়, সময়তো কেবল যেন এন্ড্রয়েডে টেম্পল রান খেলার জন্যই বরাদ্দ!
অনেক বেশি লিখে ফেলছি, এবার শেষ করতে হয়। না হলে এই লেখারও পাঠক পাওযা দুষ্কর হয়ে উঠবে। আসলে ২০১৩ পর্যন্ত প্রকাশনা জগতের অভিজ্ঞতা এবং যাপিত জীবনের নৈরাশ্য সমূহ ২০১৪ তে গ্রন্থ প্রকাশের প্রতি অনিহা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লোভ পিছু ছাড়েনি। আমি বোধহয় বইমেলায় ষ্টলে নিজের লেখা একটি বই দেখার জন্য নেশাতুর প্রাণীসম। অনুজ এক প্রিয় কবি তাহমিদের যৌথ প্রকাশনার প্রস্তাব তাও আবার প্রথম বারের মত বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনী , আমার সে লালসায় ঘৃতাহুতি দিলো। প্রকাশের পথে চলে গেলো এক রঙা এক ঘুড়ি প্রকাশনার অধীন কল্প এবং...। অন্যদিকে নিজের সারাবছরের বাছাই গল্পগুলো নিয়ে একটা পান্ডুলিপি বানিয়ে প্রকাশকদের নিকট ধর্ণা দিচ্ছিলাম ভাবছিলাম কেউ পড়বে, রাজী হবে। বরং বানিজ্য করার যে অভিলাষ আসল তাদের কাছ থেকে আমার নিরুৎসাহের পাল্লা ভাড়ি করল তা। তবে ভাষাচিত্রের প্রকাশককে পূর্ব প্রকাশের সম্পর্কের সূত্র ধরে রাজী করানো সম্ভব হলো সাদাকালো শ্যাওল বইটির প্রকাশনা খরচে অংশীদার হওয়ার মাধ্যমে। তবে যেভাবে হোক বেশ কিছু বই বিক্রি করে দেবো কি এক বিশ্বাসে প্রকাশককে বলে ফেলেছিলাম।
একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৪ এর ৭ম দিবস শেষ হয়ে গেছে। দিবসটি শুক্রবার। উপচে পড়া ভীড় ছিলো মেলায়। অথচ আমার নতুন বইদুটোর একটিও মেলার মুখ দেখেনি। সংখ্যায় খুব ক্ষুদ্র, তবুও দুএকজন ক্রেতা বই খুঁজেছে, কাছে এসে বই চেয়েছে, একজন তো পরশুদিন দেশের বাইরেই চলে গেছে। একটা বই কিনতে চেয়েছিল দেশের বাইরে যাওয়ার আগে।
ঐ যে আগেই বলেছি হয়তো পাঠকের মনে নাড়া দিতে পারি নি আজও এক চুলও, তেমন কিছু হয়তো লিখতেই পারি নি, তাই হয়তো পাঠক নেই, ক্রেতা নেই, প্রকাশকদের মুখে হাসি নেই, মেলায় বই আসার তাড়া নেই,  তাই হয়তো এর পর থেকে বই প্রকাশ করানোর ইচ্ছেটাও নেমে যাবে ইচ্ছে মিটারে শূণ্যের কোঠায়।
হয়তো লেখক হয়ে ওঠাটা আর হবেই না। হয়তো দ্রুতই এই বইমেলা কেন্দ্রিক প্রকাশনা যুদ্ধে হারিয়ে যাব। কিন্তু সেই গোড়ার কথায় আসি, সেই তারা যারা সাহিত্য জগতের উচ্চ আসনে নাক উঁচু করে বসে থাকেন তাদের কাছে দাবী জানাব, সাহিত্য প্রকাশনার এই জগতটি গ্রন্থমেলা কেন্দ্রিকতায় আর বন্দী রাখবেন না, প্রকাশকে বিস্তৃত করুণ সর্বত্র। আসুন সবাই মিলে স্বপ্ন দেখি সারাবছর বই বেরোচ্ছে, নতুন নতুন লেখক উঠে এসেছে, পাড়া মহল্লায় আবার গড়ে উঠছে বইয়ের দোকান, বেড়েই চলেছে পাঠক। আসলে পাঠক সৃষ্টি না হলে লেখক সৃষ্টি হবে কি করে, সবাইতো আর জীবনানন্দ নয় যে ট্রাংক ভর্তি লেখা রেখে যাবেন অবশ্য আধুনিক এই যুগে অনেকই কিন্তু অনলাইনে জমিয়ে ফেলেছেন প্রচুর লেখা।

1 টি মন্তব্য:

  1. অত্যন্ত সময়োপযোগী লেখা। আমাদের সময় (উনিশ শ সত্তরের দশকে) হাতে গোনা কয়েকটা সংবাদপত্র / সাময়িকী ছিলো। কিন্তু সে কয়টি সংবাদপত্র / সাময়িকী লেখক সৃষ্টিতে যে অবদান রেখেছে, আজকের ডজন ডজন পত্রিকা তার ধারে কাছেও যেতে পারছেনা। আজকের লেখকেরা ছাপার অক্ষরে লেখা প্রকাশ করার সুযোগ না পেয়ে ইন্টারনেটে ঝুঁকে পড়ছেন। এখনকার প্রকাশকদের রিস্ক নিয়ে বই প্রকাশ করতে হয়না। বই প্রকাশ করার আগে লাভের গুড় তাদের সিন্দুকে পৌঁছে যায় - বই বিক্রি হোক বা না হোক। তাই তারা মানসম্মত বই খোঁজার কষ্ট না করে পকেট ভারী লেখকদের খুঁজেন। সুতরাং ফল অনুমানযোগ্য।

    উত্তরমুছুন